শেয়ারবাজার :::: বাংলাদেশ ব্যাংক তদন্তে নেমে প্রতিষ্ঠানটির কোনো ঠিকানা খুঁজে না পেয়ে বলেছে, এটি একটি অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান। অথচ এই 'অস্তিত্বহীনকেই' ৩৫ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে বেসরকারি খাতের ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবিএল)। আরো দেওয়া হয়েছে ১০ কোটি টাকার এলসি লিমিট। প্রতিষ্ঠানটি কাপড় আমদানি করে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে সরবরাহের কথা বলে ঋণ পেলেও ওই অর্থ ব্যবহার করেছে জমি ক্রয়ে। শুধু তাই নয়, ঋণসীমার অতিরিক্ত আরো ২০ কোটি টাকা ঋণ পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদনের আগেই প্রতিষ্ঠানটিকে দেওয়া হয়েছে। এমনকি প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে সম্পর্ক নেই এমন ব্যক্তিকেও প্রায় ৩৩ কোটি টাকার পে-অর্ডার দেওয়া হয়। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে ব্যাংকটির এত সব বিস্ময়কর গুরুতর অনিয়ম ধরা পড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মেসার্স রতন ট্রেডার্স নাম নেওয়া প্রতিষ্ঠানটি ২০১০ সালের ১ আগস্ট ট্রেড লাইসেন্স পায় এবং ইউসিবিএল করপোরেট শাখায় ৫ আগস্ট চলতি হিসাব খোলে। প্রতিষ্ঠানটি কাপড় আমদানি করে তা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরবরাহের জন্য সিসি; এলটিআর বাবদ ৮০ কোটি এবং এলসি বাবদ ১০০ কোটি টাকা ঋণের জন্য ৭ আগস্ট আবেদন করে। করপোরেট শাখা পরের মাসের ২৬ তারিখে ঋণ প্রস্তাবটি প্রধান শাখায় হস্তান্তর করলে ২৭ সেপ্টেম্বরই রতন ট্রেডার্সকে ৩৫ কোটি টাকা ওভার ড্রাফট এবং ১০ কোটি টাকার এলসি লিমিট দেয় পরিচালনা পর্ষদ। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি এ ঋণের টাকা ব্যয় করে জমি ক্রয়ে। পরে ঋণসীমা আরো ২০ কোটি টাকা বাড়িয়ে নেওয়ার জন্য আবেদন করে। ইউসিবিএল কর্তৃপক্ষ এই ঋণসীমা মঞ্জুরের এক সপ্তাহ আগেই রতন ট্রেডার্সকে আবেদনকৃত বাড়তি ঋণসীমার টাকা ছাড় করে দেয়। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটিকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে বন্ধকীকৃত জমি অতিমূল্যায়িত করে দেখায় ইউসিবিএল কর্তৃপক্ষ।
অস্তিত্ববিহীন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ প্রদান
ইউসিবিএলের নথিতে থাকা মেসার্স রতন ট্রেডার্স নামের প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা খুঁজে পায়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শকদল। ব্যাংকের কাছে রক্ষিত ট্রেড লাইসেন্সে একটি ঠিকানা উল্লেখ থাকলেও ওই ঠিকানায় গিয়ে এ নামের কোনো প্রতিষ্ঠান খুঁজে পাওয়া যায়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, 'এলসি লিমিট থাকা সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠানটি পরিদর্শন তারিখ পর্যন্ত কোনো এলসি স্থাপন করেনি এবং কাপড় ক্রয়-বিক্রয়সংক্রান্ত বিল বা স্টক রিপোর্ট নথিতে পাওয়া যায়নি। এর ব্যবসায়িক বা আউটলেট বা মজুদ গুদামের কোনো ঠিকানা নথিতে পাওয়া যায়নি। ব্যাংক প্রদত্ত এবং ট্রেড লাইসেন্সে উলি্লখিত অফিস ঠিকানা সরেজমিনে পরিদর্শনকালে ওই নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের বাস্তব অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। শুধু ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের জন্যই ট্রেড লাইসেন্স নেওয়া হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।
ঋণের অর্থ ভিন্ন খাতে ব্যবহার
ওডি (ওভার ড্রাফট) হিসাব থেকে ২৫ অক্টোবর এক কোটি ১০ লাখ টাকা এবং ৩২ কোটি ৬৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা রতন ট্রেডার্সের চলতি হিসাবে স্থানান্তরের মাধ্যমে ঋণের অর্থ বিতরণ করা হয়। ওই তারিখেই চলতি হিসাব থেকে চেকের মাধ্যমে এক কোটি ১০ লাখ টাকা নগদ উত্তোলন করা হয় এবং ৩২ কোটি ৬৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা এমএনএইচ বুলু নামের এক ব্যক্তিকে পে-অর্ডারের মাধ্যমে দেওয়া হয়। বুলুর অনুকূলে ইস্যুকৃত পে-অর্ডারের টাকা পরের দিন ২৬ সেপ্টেম্বর পূবালী ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখা থেকে সংগ্রহ করা হয়।
বুলুর সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির কোনো ব্যবসায়িক লেনদেন না থাকা সত্ত্বেও এ বিপুল পরিমাণ অর্থ তাঁর অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা হয়েছে। এ সন্দেহজনক লেনদেনের বিষয়ে ইউসিবিএল কর্তৃপক্ষ কোনো আপত্তি করেনি, যা গুরুতর অনিয়ম। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'উলি্লখিত ৩২ কেটি ৬৪ লাখ টাকা কী উদ্দেশ্যে জনাব বুলুকে প্রদান করা হয়েছে, সে বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ইউসিবিএল কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি। প্রকৃতপক্ষে বুলুর সঙ্গে রতন ট্রেডাসের্র ব্যবসায়িক সম্পর্ক আছে বলে প্রতীয়মান হয়নি। শাখায় রক্ষিত দলিলাদি যাচাইকালে দেখা যায়, বন্ধকীকৃত জমি বুলুর কাছ থেকে ক্রয় করে ২০১০ সালের ২৫ অক্টোবর রতন ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী আলী আকবর খান রতনের নামে দলিল সম্পাদিত হয়েছে। অন্যদিকে পূবালী ব্যাংক লিমিটেডের প্রিন্সিপাল শাখায় পরিদর্শনকালে দেখা যায়, একই জমি বুলুর ঋণ হিসাবের বিপরীতে বন্ধকি ছিল এবং প্রাপ্ত পে-অর্ডারের মাধ্যমে বুলুর ঋণ হিসাব সমন্বয় করে বন্ধকি জমি ছাড় করা হয়েছে। এতে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে বন্ধকীকৃত জমি ক্রয়ের মূল্য বাবদ বুলুকে ওই অর্থ প্রদান করা হয়েছে। অর্থাৎ ঋণের অর্থ ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ব্যবহার না করে জমি ক্রয়ের মূল্য বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে, যা গুরুতর অনিয়ম।'
অনুমোদনের আগেই অর্থ প্রদান
রতন ট্রেডার্স অনুমোদিত ঋণসীমার বিপরীতে ছাড়কৃত অর্থ জমি ক্রয় বাবদ খরচ করে ব্যবসায়িক জরুরি প্রয়োজনের কথা বলে সীমার অতিরিক্ত আরো ২০ কোটি টাকা মঞ্জুরের জন্য ইউসিবিএলের করপোরেট শাখায় ২০১০ সালের ১ নভেম্বর আবেদন করে। করপোরেট শাখা প্রস্তাবটি একই তারিখে প্রধান কার্যালয়ে পাঠায়। ইউসিবিএলের পরিচালনা পর্ষদের ১০ নভেম্বরের সভা অতিরিক্ত ঋণসীমারও অনুমোদন দেয়। কিন্তু বিস্ময়কর হচ্ছে, করপোরেট শাখা তার এক সপ্তাহ আগেই ৩ নভেম্বর ২০ কোটি টাকা বিতরণ করে। রতন ট্রেডার্স ওই ২০ কোটি টাকা চেকের মাধ্যমে রূপায়ণ হাউজিং লিমিটেডকে দেয়, যা জনতা ব্যাংক লিমিটেডের মহাখালীর করপোরেট শাখা থেকে ওই তারিখেই নিকাশ ঘরের মাধ্যমে সংগ্রহীত হয়। জনতা ব্যাংকের মহাখালী করপোরেট শাখা পরিদর্শনকালে দেখা যায়, ওই টাকা রূপায়ণ হাউজিং লিমিটেডের একটি ঋণ হিসাবে জমা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'রতন ট্রেডার্স একটি কাপড় আমদানি ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বিধায় রূপায়ণ হাউজিংয়ের সঙ্গে তার কোনো ব্যবসায়িক সম্পর্ক থাকার কথা নয়। তা ছাড়া আলী আকবর খান রতন রূপায়ণ হাউজিং লিমিটেডের পরিচালকও নন। কাজেই সীমাতিরিক্ত ২০ কোটি টাকা ঋণ সংশ্লিষ্ট কাজে ব্যবহার না করে অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।'
এমনকি রতন ট্রেডার্সের লেনদেনের (ট্রানজেকশন) প্রোফাইল অনুযায়ী চেকের মাধ্যমে একক লেনদেনে সর্বোচ্চ দুই কোটি টাকা উত্তোলনের ঘোষণা থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি ওই হিসাব থেকে ৩২ কোটি ৬৪ লাখ টাকা পে-অর্ডার করে। অথচ ইউসিবিএল এ লেনদেনের বিষয়ে কোনো আপত্তি করেনি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে মানি লন্ডারিং বিভাগেও রিপোর্ট করেনি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রতন ট্রেডার্সের চলতি হিসাবে সংযোজিত ট্রানজেকশন প্রোফাইল পরীক্ষান্তে দেখা যায়, ট্রান্সফার বা ইনস্ট্রুমেন্টের মাধ্যমে একক লেনদেনে সর্বোচ্চ দুই কোটি টাকা উত্তোলনের ঘোষণা থাকলেও ওই হিসাব থেকে ২০১০ সালের ২৫ অক্টোবর ৩২ কোটি ৬৪ লাখ টাকা পে-অর্ডার ইস্যু এবং ৩ নভেম্বর ২০ কোটি টাকা নিকাশ চেকের মাধ্যমে উত্তোলন করা হয়েছে, যা বাংলাদেশ ব্যাংকে রিপোর্ট করা হয়নি।
ঋণের বন্ধকি ছিল অতিমূল্যায়িত
রতন ট্রেডার্সকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকের কাছে রক্ষিত প্রতিষ্ঠানটির বন্ধকি জমিকে অতিমূল্যায়িত করে দেখানো হয়েছে। এ বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, 'নথি থেকে দেখা যায়, শাখা কর্তৃক ২০১০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বরে মর্টগেজকৃত সম্পত্তি বাজারমূল্য যাচাইপূর্বক ১১০ কোটি ৫৯ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। অন্যদিকে একই সম্পত্তি এক মাসের মাথায় ২৫ অক্টোবর মাত্র ১৪ কোটি ৪৫ লাখ টাকায় গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের (রতন ট্রেডার্স) স্বত্বাধিকারী কর্তৃক ক্রয় করা হয়েছে মর্মে দলিলে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে প্রতীয়মান হয় যে, শাখা কর্তৃক মর্টগেজকৃত সম্পত্তি অতিমূল্যায়িত করে গ্রাহককে বেশি ঋণ সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নমনীয় আচরণ ও ইউসিবিএলের বক্তব্য
এত সব অনিয়ম সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ (বিআরপিডি) ব্যাংকটির বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে রহস্যজনক আচরণ করছে। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এ ক্ষেত্রে বাইরের চাপ আছে। এ কারণেই আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারছি না।'
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগ এক নথিতে উল্লেখ করেছে, 'পরিদর্শন দল প্রণীত প্রতিবেদনে ইউসিবিএলের করপোরেট শাখার গ্রাহক মেসার্স রতন ট্রেডার্সের ঋণ মঞ্জুরি, বিতরণ, ঋণের ব্যবহার ও হিসাব পরিচালনার বিষয়ে একাধিক অনিয়মের বিস্তারিত বিবরণ ও সারসংক্ষেপ উল্লেখ করা হয়েছিল। কিন্তু বিবেচ্যপত্র এবং এর সঙ্গে পাঠানো দলিলাদি থেকে দেখা যায়, ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ (বিআরপিডি) কর্তৃক ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো পত্রে মাত্র একটি অনিয়ম (বাস্তব অস্তিত্ববিহীন প্রতিষ্ঠান) উল্লেখ করে ঋণ হিসাবটি সমন্বয়ের জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।'
এ ব্যাপারে বিআরপিডি বিভাগে যোগাযোগ করে জানা যায়, পরবর্তীকালে এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এক মাসের মধ্যে অবহিত করতে বলা হয়েছে। কিন্তু নির্দিষ্ট সময় পার হলেও ইউসিবিএল এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এ বিষয়ে কিছুই জানায়নি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনের বিষয়ে ইউসিবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম শাহজাহান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, এটি একটি অস্তিত্ববিহীন প্রতিষ্ঠান। কিন্তু যে প্রতিষ্ঠান ট্যাঙ্ দিয়েছে, যার টিআইএন নম্বর আছে সেটি কিভাবে অস্তিত্ববিহীন প্রতিষ্ঠান হয় তা আমার বোধগম্য নয়।'
এম শাহজাহান বলেন, 'এ ক্ষেত্রে যে অনিয়ম হয়েছে তা হলো প্রতিষ্ঠানটি ঋণ নিয়ে জমি কিনেছে। এ জন্য গ্রাহক আমাদের ঋণ পরিশোধ করে দিচ্ছে। ইতিমধ্যেই গ্রাহক প্রতিষ্ঠানটি আমাদের ৩২ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ করে দিয়েছে এবং বাকি ঋণও ফেরত দেওয়ার জন্য সময় চেয়েছে।'
ব্যাংকের অভ্যন্তরের জড়িত ব্যক্তিদের বিষয়ে এক মাসের মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা সম্পর্কে এম শাহাজাহান বলেন, 'বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে অস্তিত্ববিহীন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়ার কারণে জড়িতদের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে। কিন্তু যেখানে প্রতিষ্ঠানটিই অস্তিত্ববিহীন নয়, সেখানে জড়িতদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেব কিভাবে?'
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মেসার্স রতন ট্রেডার্স নাম নেওয়া প্রতিষ্ঠানটি ২০১০ সালের ১ আগস্ট ট্রেড লাইসেন্স পায় এবং ইউসিবিএল করপোরেট শাখায় ৫ আগস্ট চলতি হিসাব খোলে। প্রতিষ্ঠানটি কাপড় আমদানি করে তা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরবরাহের জন্য সিসি; এলটিআর বাবদ ৮০ কোটি এবং এলসি বাবদ ১০০ কোটি টাকা ঋণের জন্য ৭ আগস্ট আবেদন করে। করপোরেট শাখা পরের মাসের ২৬ তারিখে ঋণ প্রস্তাবটি প্রধান শাখায় হস্তান্তর করলে ২৭ সেপ্টেম্বরই রতন ট্রেডার্সকে ৩৫ কোটি টাকা ওভার ড্রাফট এবং ১০ কোটি টাকার এলসি লিমিট দেয় পরিচালনা পর্ষদ। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি এ ঋণের টাকা ব্যয় করে জমি ক্রয়ে। পরে ঋণসীমা আরো ২০ কোটি টাকা বাড়িয়ে নেওয়ার জন্য আবেদন করে। ইউসিবিএল কর্তৃপক্ষ এই ঋণসীমা মঞ্জুরের এক সপ্তাহ আগেই রতন ট্রেডার্সকে আবেদনকৃত বাড়তি ঋণসীমার টাকা ছাড় করে দেয়। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটিকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে বন্ধকীকৃত জমি অতিমূল্যায়িত করে দেখায় ইউসিবিএল কর্তৃপক্ষ।
অস্তিত্ববিহীন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ প্রদান
ইউসিবিএলের নথিতে থাকা মেসার্স রতন ট্রেডার্স নামের প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা খুঁজে পায়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শকদল। ব্যাংকের কাছে রক্ষিত ট্রেড লাইসেন্সে একটি ঠিকানা উল্লেখ থাকলেও ওই ঠিকানায় গিয়ে এ নামের কোনো প্রতিষ্ঠান খুঁজে পাওয়া যায়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, 'এলসি লিমিট থাকা সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠানটি পরিদর্শন তারিখ পর্যন্ত কোনো এলসি স্থাপন করেনি এবং কাপড় ক্রয়-বিক্রয়সংক্রান্ত বিল বা স্টক রিপোর্ট নথিতে পাওয়া যায়নি। এর ব্যবসায়িক বা আউটলেট বা মজুদ গুদামের কোনো ঠিকানা নথিতে পাওয়া যায়নি। ব্যাংক প্রদত্ত এবং ট্রেড লাইসেন্সে উলি্লখিত অফিস ঠিকানা সরেজমিনে পরিদর্শনকালে ওই নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের বাস্তব অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। শুধু ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের জন্যই ট্রেড লাইসেন্স নেওয়া হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।
ঋণের অর্থ ভিন্ন খাতে ব্যবহার
ওডি (ওভার ড্রাফট) হিসাব থেকে ২৫ অক্টোবর এক কোটি ১০ লাখ টাকা এবং ৩২ কোটি ৬৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা রতন ট্রেডার্সের চলতি হিসাবে স্থানান্তরের মাধ্যমে ঋণের অর্থ বিতরণ করা হয়। ওই তারিখেই চলতি হিসাব থেকে চেকের মাধ্যমে এক কোটি ১০ লাখ টাকা নগদ উত্তোলন করা হয় এবং ৩২ কোটি ৬৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা এমএনএইচ বুলু নামের এক ব্যক্তিকে পে-অর্ডারের মাধ্যমে দেওয়া হয়। বুলুর অনুকূলে ইস্যুকৃত পে-অর্ডারের টাকা পরের দিন ২৬ সেপ্টেম্বর পূবালী ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখা থেকে সংগ্রহ করা হয়।
বুলুর সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির কোনো ব্যবসায়িক লেনদেন না থাকা সত্ত্বেও এ বিপুল পরিমাণ অর্থ তাঁর অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা হয়েছে। এ সন্দেহজনক লেনদেনের বিষয়ে ইউসিবিএল কর্তৃপক্ষ কোনো আপত্তি করেনি, যা গুরুতর অনিয়ম। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'উলি্লখিত ৩২ কেটি ৬৪ লাখ টাকা কী উদ্দেশ্যে জনাব বুলুকে প্রদান করা হয়েছে, সে বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ইউসিবিএল কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি। প্রকৃতপক্ষে বুলুর সঙ্গে রতন ট্রেডাসের্র ব্যবসায়িক সম্পর্ক আছে বলে প্রতীয়মান হয়নি। শাখায় রক্ষিত দলিলাদি যাচাইকালে দেখা যায়, বন্ধকীকৃত জমি বুলুর কাছ থেকে ক্রয় করে ২০১০ সালের ২৫ অক্টোবর রতন ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী আলী আকবর খান রতনের নামে দলিল সম্পাদিত হয়েছে। অন্যদিকে পূবালী ব্যাংক লিমিটেডের প্রিন্সিপাল শাখায় পরিদর্শনকালে দেখা যায়, একই জমি বুলুর ঋণ হিসাবের বিপরীতে বন্ধকি ছিল এবং প্রাপ্ত পে-অর্ডারের মাধ্যমে বুলুর ঋণ হিসাব সমন্বয় করে বন্ধকি জমি ছাড় করা হয়েছে। এতে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে বন্ধকীকৃত জমি ক্রয়ের মূল্য বাবদ বুলুকে ওই অর্থ প্রদান করা হয়েছে। অর্থাৎ ঋণের অর্থ ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ব্যবহার না করে জমি ক্রয়ের মূল্য বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে, যা গুরুতর অনিয়ম।'
অনুমোদনের আগেই অর্থ প্রদান
রতন ট্রেডার্স অনুমোদিত ঋণসীমার বিপরীতে ছাড়কৃত অর্থ জমি ক্রয় বাবদ খরচ করে ব্যবসায়িক জরুরি প্রয়োজনের কথা বলে সীমার অতিরিক্ত আরো ২০ কোটি টাকা মঞ্জুরের জন্য ইউসিবিএলের করপোরেট শাখায় ২০১০ সালের ১ নভেম্বর আবেদন করে। করপোরেট শাখা প্রস্তাবটি একই তারিখে প্রধান কার্যালয়ে পাঠায়। ইউসিবিএলের পরিচালনা পর্ষদের ১০ নভেম্বরের সভা অতিরিক্ত ঋণসীমারও অনুমোদন দেয়। কিন্তু বিস্ময়কর হচ্ছে, করপোরেট শাখা তার এক সপ্তাহ আগেই ৩ নভেম্বর ২০ কোটি টাকা বিতরণ করে। রতন ট্রেডার্স ওই ২০ কোটি টাকা চেকের মাধ্যমে রূপায়ণ হাউজিং লিমিটেডকে দেয়, যা জনতা ব্যাংক লিমিটেডের মহাখালীর করপোরেট শাখা থেকে ওই তারিখেই নিকাশ ঘরের মাধ্যমে সংগ্রহীত হয়। জনতা ব্যাংকের মহাখালী করপোরেট শাখা পরিদর্শনকালে দেখা যায়, ওই টাকা রূপায়ণ হাউজিং লিমিটেডের একটি ঋণ হিসাবে জমা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'রতন ট্রেডার্স একটি কাপড় আমদানি ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বিধায় রূপায়ণ হাউজিংয়ের সঙ্গে তার কোনো ব্যবসায়িক সম্পর্ক থাকার কথা নয়। তা ছাড়া আলী আকবর খান রতন রূপায়ণ হাউজিং লিমিটেডের পরিচালকও নন। কাজেই সীমাতিরিক্ত ২০ কোটি টাকা ঋণ সংশ্লিষ্ট কাজে ব্যবহার না করে অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।'
এমনকি রতন ট্রেডার্সের লেনদেনের (ট্রানজেকশন) প্রোফাইল অনুযায়ী চেকের মাধ্যমে একক লেনদেনে সর্বোচ্চ দুই কোটি টাকা উত্তোলনের ঘোষণা থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি ওই হিসাব থেকে ৩২ কোটি ৬৪ লাখ টাকা পে-অর্ডার করে। অথচ ইউসিবিএল এ লেনদেনের বিষয়ে কোনো আপত্তি করেনি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে মানি লন্ডারিং বিভাগেও রিপোর্ট করেনি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রতন ট্রেডার্সের চলতি হিসাবে সংযোজিত ট্রানজেকশন প্রোফাইল পরীক্ষান্তে দেখা যায়, ট্রান্সফার বা ইনস্ট্রুমেন্টের মাধ্যমে একক লেনদেনে সর্বোচ্চ দুই কোটি টাকা উত্তোলনের ঘোষণা থাকলেও ওই হিসাব থেকে ২০১০ সালের ২৫ অক্টোবর ৩২ কোটি ৬৪ লাখ টাকা পে-অর্ডার ইস্যু এবং ৩ নভেম্বর ২০ কোটি টাকা নিকাশ চেকের মাধ্যমে উত্তোলন করা হয়েছে, যা বাংলাদেশ ব্যাংকে রিপোর্ট করা হয়নি।
ঋণের বন্ধকি ছিল অতিমূল্যায়িত
রতন ট্রেডার্সকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকের কাছে রক্ষিত প্রতিষ্ঠানটির বন্ধকি জমিকে অতিমূল্যায়িত করে দেখানো হয়েছে। এ বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, 'নথি থেকে দেখা যায়, শাখা কর্তৃক ২০১০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বরে মর্টগেজকৃত সম্পত্তি বাজারমূল্য যাচাইপূর্বক ১১০ কোটি ৫৯ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। অন্যদিকে একই সম্পত্তি এক মাসের মাথায় ২৫ অক্টোবর মাত্র ১৪ কোটি ৪৫ লাখ টাকায় গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের (রতন ট্রেডার্স) স্বত্বাধিকারী কর্তৃক ক্রয় করা হয়েছে মর্মে দলিলে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে প্রতীয়মান হয় যে, শাখা কর্তৃক মর্টগেজকৃত সম্পত্তি অতিমূল্যায়িত করে গ্রাহককে বেশি ঋণ সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নমনীয় আচরণ ও ইউসিবিএলের বক্তব্য
এত সব অনিয়ম সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ (বিআরপিডি) ব্যাংকটির বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে রহস্যজনক আচরণ করছে। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এ ক্ষেত্রে বাইরের চাপ আছে। এ কারণেই আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারছি না।'
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগ এক নথিতে উল্লেখ করেছে, 'পরিদর্শন দল প্রণীত প্রতিবেদনে ইউসিবিএলের করপোরেট শাখার গ্রাহক মেসার্স রতন ট্রেডার্সের ঋণ মঞ্জুরি, বিতরণ, ঋণের ব্যবহার ও হিসাব পরিচালনার বিষয়ে একাধিক অনিয়মের বিস্তারিত বিবরণ ও সারসংক্ষেপ উল্লেখ করা হয়েছিল। কিন্তু বিবেচ্যপত্র এবং এর সঙ্গে পাঠানো দলিলাদি থেকে দেখা যায়, ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ (বিআরপিডি) কর্তৃক ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো পত্রে মাত্র একটি অনিয়ম (বাস্তব অস্তিত্ববিহীন প্রতিষ্ঠান) উল্লেখ করে ঋণ হিসাবটি সমন্বয়ের জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।'
এ ব্যাপারে বিআরপিডি বিভাগে যোগাযোগ করে জানা যায়, পরবর্তীকালে এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এক মাসের মধ্যে অবহিত করতে বলা হয়েছে। কিন্তু নির্দিষ্ট সময় পার হলেও ইউসিবিএল এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এ বিষয়ে কিছুই জানায়নি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনের বিষয়ে ইউসিবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম শাহজাহান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, এটি একটি অস্তিত্ববিহীন প্রতিষ্ঠান। কিন্তু যে প্রতিষ্ঠান ট্যাঙ্ দিয়েছে, যার টিআইএন নম্বর আছে সেটি কিভাবে অস্তিত্ববিহীন প্রতিষ্ঠান হয় তা আমার বোধগম্য নয়।'
এম শাহজাহান বলেন, 'এ ক্ষেত্রে যে অনিয়ম হয়েছে তা হলো প্রতিষ্ঠানটি ঋণ নিয়ে জমি কিনেছে। এ জন্য গ্রাহক আমাদের ঋণ পরিশোধ করে দিচ্ছে। ইতিমধ্যেই গ্রাহক প্রতিষ্ঠানটি আমাদের ৩২ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ করে দিয়েছে এবং বাকি ঋণও ফেরত দেওয়ার জন্য সময় চেয়েছে।'
ব্যাংকের অভ্যন্তরের জড়িত ব্যক্তিদের বিষয়ে এক মাসের মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা সম্পর্কে এম শাহাজাহান বলেন, 'বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে অস্তিত্ববিহীন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়ার কারণে জড়িতদের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে। কিন্তু যেখানে প্রতিষ্ঠানটিই অস্তিত্ববিহীন নয়, সেখানে জড়িতদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেব কিভাবে?'