পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে কঠোর বাই-ব্যাক (পুনঃ ক্রয়) আইনের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। শেয়ার বাই-ব্যাকের (পুনঃ ক্রয়) চূড়ান্ত খসড়ায় বিধি লঙ্ঘনের দায়ে সংশ্লিষ্ট কম্পানির দায়ী প্রত্যেক কর্মকর্তাকে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হচ্ছে। এ ছাড়া শেয়ার বাই-ব্যাকের পর ৩৬৫ দিনের মধ্যে ওই কম্পানি দেউলিয়া হলে কম্পানির পরিচালক পর্ষদের সব সদস্য একক ও সম্মিলিতভাবে দায়বদ্ধ থাকবেন। আর কম্পানি বাই-ব্যাক সম্পন্ন করার পরের সাত কর্মদিবসের মধ্যে কেনা সিকিউরিটিজ বাতিল ও ধ্বংস করে ফেলবে। এ ছাড়া শেয়ার ডিম্যাট (ইলেকট্রনিক) আকারে থাকলে তা অবলোপন করতে হবে। খসড়াটি আইনে অনুমোদিত হলে পুঁজিবাজারে স্থিতি ফিরে আসবে বলে মনে করছে কম্পানি আইন সংশোধনী প্রণয়ন কমিটি। কমিটির এক সদস্য জানান, শেয়ার বাই-ব্যাক পদ্ধতি চালু করতে এসব বিধান রেখে সংশোধিত করা হচ্ছে কম্পানি আইন, ১৯৯৪। বর্তমানে সংশোধনীর খসড়া চূড়ান্তপর্যায়ে রয়েছে। এখন খসড়াটি মন্ত্রিসভা বৈঠকের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। পরে আইন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর মন্ত্রিসভা কমিটির চূড়ান্ত অনুমোদন হয়ে সংসদের আগামী শীতকালীন অধিবেশনে পাস হওয়ার কথা রয়েছে। শেয়ার বাই-ব্যাক পদ্ধতি চালু হলে কম্পানি আইনের ৫৯ থেকে ৭০ ধারার বিধানগুলো কার্যকর থাকবে না। এ বিষয়ে বাণিজ্যসচিব মো. গোলাম হোসেন গতকাল সোমবার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'শেয়ার বাই-ব্যাক পদ্ধতি প্রবর্তন করতে কম্পানি আইন ১৯৯৪-এর ৫৮ ধারা সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যেই খসড়াটি প্রায় চূড়ান্ত করা হয়েছে।' কম্পানি আইনের সংশোধনী সম্পর্কে মন্ত্রিসভা বৈঠকের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তৈরি করা সার সংক্ষেপে বলা হয়েছে, পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার জন্যই এ পদ্ধতি প্রবর্তন করা হচ্ছে। প্রস্তাবিত সংশোধনী সরকার অনুমোদন করলে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে। কম্পানিগুলোর সার্বিক কার্যক্রম দ্রুত নিষ্পত্তি, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত হবে। চূড়ান্ত খসড়ার ৫৮(৩) ধারায় বলা হয়েছে, 'কোন কোম্পানী এই ধারার বিধান লঙ্ঘন করিয়া কোন কিছু করিলে, উক্ত কোম্পানী এবং উহার প্রত্যেক কর্মকর্তা, যিনি জ্ঞাতসারে ও ইচ্ছাকৃতভাবে তজ্জন্য দোষী তিনিও অনধিক পাঁচ লক্ষ টাকা করিয়া অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন।' ৫৮(৮) উপধারায় বলা হয়েছে, 'কোন কোম্পানী এই ধারার অধীনে বাই-ব্যাক সম্পন্ন করিবার পরবর্তী ২৪ মাসের মধ্যে উক্ত প্রকার আর কোন শেয়ার ইস্যু করিতে পারিবে না।' খসড়ায় বলা হয়েছে, কোনো কম্পানি ফ্রি রিজার্ভ (বিধিবদ্ধ রিজার্ভ ছাড়া পুঞ্জীভূত মুনাফা ও সাধারণ রিজার্ভ) ও সিকিউরিটির প্রিমিয়াম হিসাব ব্যবহারের মাধ্যমেও নিজস্ব সাধারণ শেয়ার কিনতে পারবে। তবে ফ্রি- রিজার্ভ ও শেয়ার প্রিমিয়াম হিসাব থেকে ১০ শতাংশের বেশি অর্থ বাই-ব্যাকের জন্য ব্যয় করা যাবে না। শেয়ার বাই-ব্যাকের ক্ষেত্রে বেশ কিছু শর্ত মানতে হবে কম্পানিগুলোকে। এর মধ্যে রয়েছে বাই-ব্যাক কম্পানির সংবিধি দ্বারা অনুমোদিত হতে হবে। কম্পানির সাধারণ সভায় শেয়ার বাই-ব্যাকের উদ্দেশ্যে বিশেষ সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কোনো বাই-ব্যাকের প্রস্তাব অনুমোদনের তারিখ থেকে পরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে নতুন করে আর কোনো প্রস্তাব গ্রহণ করা যাবে না। আর বাই-ব্যাকের পরিমাণ কম্পানির মোট পরিশোধিত মূলধনের ১৫ শতাধিক বেশি হবে না। এ ছাড়া বাই-ব্যাকের পর কম্পানির দায়ের (অনিরাপদ ও নিরাপদ) পরিমাণ তার মোট মূলধন ও ফ্রি-রিজার্ভের দ্বিগুণের বেশি হবে না। তবে সিকিউরিটিজ ও এঙ্চেঞ্জ কমিশন প্রয়োজনে কোনো খাতের কম্পানির জন্য দায়ের পরিমাণ বাড়াতে পারে। অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকা খসড়ায় আরো বলা হয়েছে, বাই-ব্যাকের জন্য নির্ধারিত সব সিকিউরিটিজ সম্পূর্ণভাবে পরিশোধিত হতে হবে। কোনো কম্পানি তার নিজস্ব বা অন্য কোনো সাবসিডিয়ারি কম্পানি বা কোনো বিনিয়োগ কম্পানি ছাড়া অন্য কোনো তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে বাই-ব্যাক সম্পন্ন করবে। খসড়ার ৫৮(২)-এর (চ) উপধারায় বলা হয়েছে, শেয়ার বাই-ব্যাকের আবেদন সিকিউরিটিজ ও এঙ্চেঞ্জ কমিশনের চূড়ান্ত অনুমোদনের দিন থেকে ৯০ দিনের মধ্যে নির্ধারিত বাই-ব্যাক সম্পন্ন করতে হবে। শেয়ার হোল্ডারদের কাছে থেকে আনুপাতিক হারে বা নিয়মিত বাজার হতে শেয়ার বাই-ব্যাক করা যাবে। এসব শর্ত লঙ্ঘন করা হলে সংশ্লিষ্ট কম্পানি বা কম্পানির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার জন্য সিকিউরিটিজ ও এঙ্চেঞ্জ কমিশন আইন, ১৯৯৩ মোতাবেক জরিমানা করা যাবে। খসড়ায় বেশ কিছু ক্ষেত্রে বাই-ব্যাক নিষিদ্ধের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে হলো_কোনো কম্পানি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে তার নিজস্ব সিকিউরিটি কিনতে পারবে না। এ ছাড়া কোনো কম্পানি তার নিজস্ব বা অন্য কোন সাবসিডিয়ারি কম্পানির মাধ্যমে, কোনো বিনিয়োগ কম্পানি বা বিনিয়োগ কম্পানির গোষ্ঠীর মাধ্যমেও কিনতে পারবে না। আর কোনো কম্পানি তার ডিবেঞ্চার বা যাবতীয় ঋণের কিস্তি বা শেয়ারের ওপর লভ্যাংশ দিতে ব্যর্থ হলেও বাই-ব্যাক করতে পারবে না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে একটা সর্বনিম্ন দামে শেয়ার কেনার নিয়ম (বাই-ব্যাক পলিসি) রয়েছে। তবে বাংলাদেশে তা নেই। ব্রিটিশ আমলে প্রণীত ১৯১৭ সালের কম্পানি আইনটি এখনো বাংলাদেশে বলবত রয়েছে। ভারত ও শ্রীলঙ্কা এ আইনে বেশ পরিবর্তন আনলেও বাংলাদেশ তা পারেনি। পরে ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গত ২১ মার্চ অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে কম্পানি আইনের ৫৮ ধারা সংশোধন করে বাই-ব্যাক পদ্ধতি চালুর অনুরোধ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে। পরে ৩০ মার্চ এ জন্য একটি আন্ত মন্ত্রণালয় সভা করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ওই সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক, ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্টস অব বাংলাদেশ, ইনস্টিটিউট অব কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউনটেন্টস অব বাংলাদেশ, ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড সেক্রেটারিজ অব বাংলাদেশ, রেজিস্ট্রার, জয়েন্ট স্টক কম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তরের মতামত নেওয়া হয়। মতামত পাওয়ার পর গত ১৪ জুন এক বৈঠকে সংশোধনী প্রস্তাব প্রস্তুতের জন্য পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি সাব-কমিটি গঠন করা হয়। পরে ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এঙ্চেঞ্জের সভাপতিকেও কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। গত ১৮ আগস্ট বাণিজ্যসচিবের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে ওই কমিটি সংশোধনী প্রস্তাবনা চূড়ান্ত আকারে দাখিল করেছে।