পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির জন্য প্রাথমিক গণপ্রস্তাবে (আইপিও) প্রিমিয়ামসহ আবেদন করা বেশিরভাগ কোম্পানির মূল লক্ষ্য ব্যবসা সম্প্রসারণ নয় বরং ব্যাংকঋণ পরিশোধ।
যা বিনিয়োগকারীদের জন্য কোনো সুফল বয়ে আনে না বলে মনে করেন বাজার বিশ্লেষকরা।
সম্প্রতি আইপিও’র অনুমোদন পাওয়া কয়েকটি কোম্পানির প্রসপেক্টাস থেকে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, এসব কোম্পানির উদ্যোক্তারা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে অত্যাধিক প্রিমিয়াম নিয়ে কোম্পানির ঋণ পরিশোধে ব্যয়ে করছেন। এতে কোম্পানিগুলোর দায়মুক্তি হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
এ প্রসঙ্গে আব্দুর রাজ্জাক নামের এক বিনিয়োগকারী অভিযোগ করে বলেন, সম্প্রতি কোম্পানির ঋণের দায় বিনিয়োগকারীদের ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। কেবল ঋণের বোঝা থেকে মুক্তির জন্য তারা অত্যাধিক প্রিমিয়াম নিয়ে কোম্পানিগুলো বাজার থেকে টাকা উত্তোলন করছে। বাজারের এ ক্রান্তিকালে যা মোটেও যুক্তিযুক্ত নয়।
তিনি আরও বলেন, আইপিও’র অনুমোদন দেওয়ার আগে এ বিষয়ে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) যথেষ্ট যাচাই-বাছাই করা উচিত। যাতে কোম্পানিগুলো কেবল ঋণ শোধ করার জন্য অত্যাধিক প্রিমিয়াম দাবি না করে অনুমোদনের আগে অবশ্যই খেয়াল রাখা উচিত।
জানা গেছে, ২০১১ সালে বাজারে রাইট শেয়ার ছেড়ে সোনারগাঁও টেক্সটাইল কোম্পানি পুঁজিবাজার থেকে মোট ১৬ কোটি ৩৬ লাখ ৮০ হাজার টাকা উত্তোলন করে। এরপর তুলা স্বল্পতা, শ্রমিক স্বল্পতা এবং বিদ্যুৎ ঘাটতির অজুহাত দেখিয়ে বাজার থেকে উত্তোলিত টাকার ১১ কোটি টাকা তাদের ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করেছে।
সম্প্রতি আইপিও’র অনুমোদন পাওয়া অ্যাপোলো ইস্পাত কোম্পানি বাজার থেকে দুই’শ ২০ কোটি টাকা উত্তোলন করবে; যার মধ্যে একশ ৪৩ কোটি টাকা দিয়ে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করবে।
মোজাফফর হোসাইন স্পিনিং মিলস কোম্পানি ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের ২ কোটি ৭৫ লাখ শেয়ার ছেড়ে ২৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা সংগ্রহ করবে। সংগৃহীত অর্থের ৯৫ শতাংশই মেয়াদি ঋণ পরিশোধে ব্যয় হবে বলে কোম্পানির প্রসপেক্টাস সূত্রে জানা গেছে।
প্যারামাইন্ট টেক্সটাইল কোম্পানিটি পুঁজিবাজার থেকে উত্তোলিত টাকার প্রায় সম্পূর্ণ ব্যবহার করছে ঋণ পরিশোধে। কোম্পানিটি পুঁজিবাজার থেকে মোট ৮৪ কোটি টাকা উত্তোলন করবে। যার মধ্যে ৭৩ কোটি টাকা দিয়ে ঋণ পরিশোধ করা হবে ও ৮ কোটি ৭০ লাখ টাকা ব্যয় হবে মূলধনের কাজে। আর বাকি ২ কোটি ২৯ লাখ টাকা আইপিওতে ব্যয় হবে।
এক্ষেত্রে বেশিরভাগ কোম্পানিতে দেখা যায়, তালিকাভুক্তির আগে ১৫-২০ শতাংশ হারে সুদ দিয়ে ব্যবসায় পরিচালনা করে যে মুনাফা অর্জন করে সেই একই পরিমাণ থেকে যায় পুঁজিবাজার থেকে সুদবিহীন টাকা উত্তোলন করে।
এদিকে, কোম্পানি কর্তৃপক্ষ পুঁজিবাজার থেকে টাকা উত্তোলন করে ৭৩ কোটি টাকার ঋণ পরিশোধ করলেও মোট ঋণের পরিমাণ আরও অনেক। প্রসপেক্টাস থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী কোম্পানিটি দীর্ঘমেয়াদী ৬৪ কোটি ৭৭ লাখ এবং স্বল্পমেয়াদী ৮৯ কোটি ৯৪ লাখসহ মোট ১৫৪ কোটি ৭২ লাখ টাকা ঋণ গ্রহণ করেছে।
ফলে পুঁজিবাজার থেকে উত্তোলিত অর্থের ৭৩ কোটি টাকা দিয়ে ঋণ পরিশোধ করলেও বাকি থেকে যাচ্ছে তার চেয়ে আরও বেশি ঋণ।
এছাড়া সায়হাম টেক্সটাইল, বাংলাদেশ বিল্ডিং সিস্টেম এবং জেনারেশন নেক্সট কোম্পানিও পুঁজিবাজার থেকে আইপিও’র মাধ্যমে টাকা উত্তোলন করে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করেছে।
তবে কোম্পানিগুলোর এ ধরনের মানসিকতাকে ইতিবাচক ভাবে নিতে পারছেন না বাজার বিশ্লেষকরা। তাদের দাবি বাজার থেকে পুঁজি সংগ্রহের উদ্দেশ্য হলো কোম্পানির উৎপাদন বৃদ্ধি করা, ঋণ পরিশোধ নয়।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, আইপিও’র টাকায় ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করা ঠিক নয়। আইপিও’র মাধ্যমে টাকা উত্তোলন করার উদ্দেশ্য হলো কোম্পানির উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো। যাতে কোম্পানির শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) বাড়ে। কিন্তু ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করলে বিনিয়োগকারীরা চূড়ান্তভাবে কোনও লাভবান হয় না।
তিনি আরও বলেন, আইপিও’র টাকায় ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করলে হয়তবা কোম্পানির মূলধন কাঠামোতে সামান্য পরিবর্তন হয় কিন্তু কোম্পানির উৎপাদনে কোনো পরিবর্তন আসে না। ফলে যারা নতুন করে কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করবেন তারা তেমন লাভবান হবেন না।
কোম্পানিগুলোর এ ধরনের প্রবণতা বন্ধে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিজি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও উভয় স্টক এক্সচেঞ্জকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।
কারণ পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে, এ ধরনের উদ্যোগ বিনিয়োগকারীদের কোনো কাজে আসে না। বরং বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হতাশা বেড়ে যায় বলেও মনে করেন মিজানুর রহমান।