রাজধানী ঢাকার অভিজাত এলাকায় বিলাসবহুল জাঁকজমকপূর্ণ জীবনযাপন এখন অনেকটাই গা-সওয়া হয়ে গেছে। কোটি টাকার বেশি দামি ফ্ল্যাট কিংবা বাড়িতে থাকেন অনেকেই। তাঁরা অহরহ বিএমডব্লিউ, মার্সিডিজ, লেক্সাস ব্র্যান্ডের গাড়ি চালান। কিন্তু আয়কর বিবরণীতে এগুলোর চিত্র উঠে আসে না। এসব সম্পদশালীর বেশির ভাগই তাঁদের আয়কর নথিতে এসব সম্পদ দেখান না। আবার যাঁরা দেখান, তাঁদের এসব সম্পদের সঠিক বাজারমূল্যও পাওয়া যায় না।
অথচ দেশে মাত্র পাঁচ হাজার ৬৬২ জন করদাতা রয়েছেন, যাঁরা দুই কোটি টাকার বেশি সম্পদের মালিক। এই হিসাব পাওয়া গেছে সরকারি প্রতিষ্ঠান জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য-উপাত্ত থেকে। ২০১২-১৩ করবর্ষের বার্ষিক আয়কর বিবরণীতে তাঁরা সবাই দুই কোটি টাকার বেশি সম্পদ দেখিয়েছেন। এতে মাশুল হিসেবে এনবিআরের রাজস্ব প্রাপ্তি হয়েছে ৬০ কোটি ৩৬ লাখ টাকা।
এর আগের অর্থবছরে চার হাজার ৪৪৬ জন করদাতা দুই কোটি টাকার বেশি সম্পদধারী ছিলেন। সেখান থেকে এনবিআর পেয়েছে ৪৪ কোটি টাকা ৬২ লাখ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে এমন কোটিপতি সম্পদধারী বেড়েছে মাত্র এক হাজার ২১৬ জন।
২০১১-১২ অর্থবছরের বাজেটে দুই কোটি টাকার বেশি সম্পদের মালিক হলে তাঁর প্রদত্ত করের ওপর ১০ শতাংশ মাশুল (সারচার্জ) হিসেবে দেওয়ার বিধান করা হয়। গত অর্থবছরেও একই হার অব্যাহত রাখা হয়।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ প্রথম আলোকে বলেন, দৃশ্যত এ দেশে বিশালসংখ্যক মানুষের দুই কোটি টাকার বেশি সম্পদ রয়েছে। তাঁদের সেই সম্পদের আর্থিক মূল্যায়ন যথাযথ ও সতর্কভাবে করতে হবে। এ জন্য গোয়েন্দা কার্যক্রমকে কাজে লাগাতে পারে এনবিআর। কিছু লোকের হাতে বিপুল পরিমাণ অপ্রদর্শিত সম্পদ রয়েছে। এতে সমাজে বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। তবে তিনি মত দেন, সম্পদ প্রদর্শনের ক্ষেত্রে করদাতা ও কর আদায়কারী—উভয় পক্ষকে দায়িত্বশীল ও কৌশলী হতে হবে।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, কর অঞ্চল-৫-এর সবচেয়ে বেশি—৫৩২ জন করদাতা দুই কোটি টাকার বেশি সম্পদ দেখিয়েছেন। জমি ও ফ্ল্যাট তথা আবাসন ব্যবসায়ীরা এই কর অঞ্চলে আয়কর বিবরণী জমা দেন।
সারচার্জ দেওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ)। এলটিইউর ৭০৬ জন করদাতার মধ্যে ৪৩৫ জন দুই কোটি টাকার বেশি সম্পদের মালিক। আগের বছরও ৪৩৫ জনই মাশুল দিয়েছিলেন। অথচ ব্যাংক, বিমা, লিজিং কোম্পানি, বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকেরা এলটিইউর আওতাভুক্ত।
এলটিইউ সূত্রে জানা গেছে, এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকদের বেশির ভাগই কোম্পানি থেকে বাড়ি, গাড়িসহ অন্যান্য সুবিধা পান বলে আয়কর বিবরণীতে দেখান।
আর চিকিৎসক, প্রকৌশলীসহ পেশাজীবীদের মধ্যে মাত্র ৩৩৩ জনের দুই কোটি টাকা বা তার বেশি মূল্যের সম্পদ রয়েছে। কর অঞ্চল-১০ তাঁদের অধিক্ষেত্র। এ ছাড়া চট্টগ্রামের বিভিন্ন কর অঞ্চল থেকে ৬৬০ জন দুই কোটি টাকা বা তার বেশি মূল্যের সম্পদের জন্য মাশুল দিয়েছেন।
এ ছাড়া ময়মনসিংহে ৫১ জন, বগুড়ায় ৩৮, গাজীপুরে ৪১ ও বরিশালে ৪৭ জন করদাতা দুই কোটি টাকার বেশি সম্পদ দেখিয়েছেন।
এনবিআরের আয়কর কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, মূলত সম্পদ হস্তান্তরের সময় মূল্যকেই বিবেচনায় আনা হয়। এতে নিবন্ধনের সময় জমি, ফ্ল্যাটের মূল্য কম দেখানো হয়। এতে কোনো জমির দাম এক কোটি টাকা হলে তা নিবন্ধিত হয় মাত্র ২০ লাখ টাকা দেখিয়ে। এতে সরকার রাজস্ব কম পায়, বছর শেষে তাও মাশুলের আওতামুক্ত থাকে। আবার ২০ বছর আগে জমি বা ফ্ল্যাটের কেনাবেচা হলে সে সময়ের দামই এখন আয়কর বিবরণীতে দেখানো হয়। এতে প্রকৃত বা বর্তমান মূল্য আয়কর বিবরণীতে প্রকাশ পায় না। ফলে বিপুলসংখ্যক করদাতাকে মাশুল দিতে হচ্ছে না।
চলতি অর্থবছর থেকে মাশুলের হার বাড়িয়ে দুই স্তরে নেওয়া হবে। ২ থেকে ১০ কোটি টাকার সম্পদের মালিক হলে প্রদত্ত করের ওপর ১০ শতাংশ মাশুল দিতে হবে। আর ১০ কোটি টাকার বেশি সম্পদের মালিক হলে এ হার হবে ১৫ শতাংশ।