জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার আহম্মেদাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য হারুঞ্জা গ্রামের সেকেন্দার আলীর বাড়ি থেকে ছয় তরুণীকে উদ্ধার করা হয়েছে। গত রবিবার রাত ৯টায় গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ অভিযান চালিয়ে তাদের উদ্ধার করে। এ ঘটনায় ইউপি সদস্যের চার স্ত্রীকে আটক করা হয়েছে। তবে অভিযান টের পেয়ে সেকেন্দার আলী তাঁর আরো দুই স্ত্রী নিয়ে পালিয়ে গেছেন। উদ্ধার পাওয়া তরুণীরা বলছে, তাদেরকে দীর্ঘদিন আটকে রেখে যৌনকর্মে বাধ্য করেছেন ওই ইউপি সদস্য।
ছয় স্ত্রী : স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে বাড়িতে যৌন ব্যবসা চালিয়ে আসছেন ওই ইউপি সদস্য। তাঁর ছয় স্ত্রীও রয়েছে। ইউপি সদস্য ছয় স্ত্রীর মাধ্যমে নতুন নতুন খদ্দের আনেন বাড়িতে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি স্ত্রীদেরও যৌনকর্মে বাধ্য করেছেন।
সুরক্ষিত কক্ষ : পুলিশ জানায়, পাকা বাড়িতে তাঁর শয়নকক্ষের সঙ্গে নির্মাণ করা হয়েছে ১৫ ফুট দীর্ঘ ও ৩ ফুট প্রস্থের পৃথক একটি সুরক্ষিত কক্ষ। এই কক্ষ থেকেই ছয় তরুণীকে উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃতদের বাড়ি জয়পুরহাট সদর (দুজন), ক্ষেতলাল উপজেলা, রাজশাহীর বাগমারা উপজেলা, জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলা ও ঢাকার কমলাপুরে।
তরুণীরা জানায়, কাজের প্রলোভন দিয়ে বিভিন্ন স্থান থেকে তাদের হারুঞ্জা গ্রামে আনা হয়েছে। এরপর তাদের যৌনকর্মে বাধ্য করা হয়। তাদের পারিশ্রমিকও দেওয়া হতো নামমাত্র। আর প্রতিবাদ করলে চালানো হতো নির্যাতন।
যেভাবে ঘটনা ফাঁস : পুলিশ জানায়, জয়পুরহাট সদর উপজেলার এক দিনমজুরের কন্যাকে প্রায় দুই বছর আগে দালালের মাধ্যমে কিনে নেন সেকেন্দার আলী। প্রায় দুই বছর ধরে সেকেন্দার আলীর বাড়িতেই থাকে মেয়েটি। তাকে যৌন ব্যবসায় বাধ্য করেন সেকেন্দার। এ অবস্থায় মেয়েটি এক খদ্দেরের কাছে উদ্ধারের আকুতি জানায়। খদ্দেরের মোবাইল ফোনের মাধ্যমে স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তরুণী। স্বজনরা বিষয়টি পুলিশকে জানায়।
ছিলেন ভ্যানচালক : এলাকাবাসী জানায়, দেখতে সুদর্শন হলেও ২০ বছর আগে এলাকায় সেকেন্দার আলীকে মানুষ চিনত ভ্যানচালক হিসেবে। সংসারের অভাব দূর করতে তিনি ঢাকায় রিকশাও চালিয়েছেন। ওই সময় ঢাকায় আসা-যাওয়ার প্রাক্কালে অপরিচিত মেয়েদের এনে বাড়িতে তিনি যৌন ব্যবসা শুরু করেন। এখন তিনি বিত্তশালী। বিশাল জায়গাজুড়ে তাঁর রয়েছে পাকা বাড়ি। যেখানে একত্রে বসবাস করেন তাঁর ছয় স্ত্রী। জায়গা-জমিও করেছেন।
যত অপকর্ম : গ্রামবাসীরা জানায়, অনৈতিক কাজের প্রতিবাদ করায় ১৯৯৮ সালে গ্রামের ব্যবসায়ী গৌতম চন্দ্র চাকীর একটি দামি গরু চুরি করে জবাই করেন ইউপি সদস্য। এ খবর ফাঁস হলে ফুঁসে ওঠে গ্রামবাসী। পেটানো হয় তাঁর কয়েকজন অনুসারিকে। ওই সময় তাঁর বিরুদ্ধে প্রথম মামলা হয়। তখন তিনি পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন। ২০১১ সালে যৌন ব্যবসার অভিযোগে কালাই থানায় আরেকটি মামলা করা হয়। এ অবস্থায় যৌন ব্যবসা ছেড়ে দেওয়ার অঙ্গীকার করেন তিনি। গ্রামবাসী তাঁর কথা বিশ্বাস করে ইউপি সদস্য হিসেবে নির্বাচিত করে। গত রবিবার ছয় তরুণী উদ্ধারের ঘটনায় মানবপাচারের অভিযোগে কালাই থানায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।
ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া : ইউপি সদস্য নির্বাচিত হয়েও যৌন ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ায় এবং ছয় তরুণী উদ্ধারের খবর জানাজানির পর এলাকার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। হারুঞ্জা গ্রামের ব্যবসায়ী গৌতম চন্দ্র চাকী বলেন, 'আমার অর্ধলাখ টাকার গরু চুরি ও জবাই করার অভিযোগে মামলা হলেও কোনো প্রতিকার পাইনি।'
আহম্মেদাবাদ ইউপির চেয়ারম্যান আবুল খয়ের গোলাম মওলা বলেন, 'তাঁকে অনেকবার শাসন করা হয়েছে। অনৈতিক কাজ ছেড়ে দেওয়ার জন্য মাজার ছুঁয়ে তিনি ওয়াদা করেছিলেন। এ কারণে গ্রামবাসী তাঁকে ইউপি সদস্য নির্বাচিত করে।' চেয়ারম্যান তাঁর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।
পুলিশের বক্তব্য : ইউপি সদস্যের বাড়ির সুরক্ষিত কক্ষ থেকে ছয় তরুণী উদ্ধারের ঘটনায় বিষ্ময় প্রকাশ করে জেলা পুলিশ সুপার হামিদুল আলম বলেন, 'মানুষ সচেতন হলে এ ধরনের অনৈতিক কাজ গ্রামে কখনো হতে পারে না। গ্রামবাসীও এর দায় এড়াতে পারে না।' তিনি এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান।