শেয়ারবাজার :::: শেয়ারবাজারের অবস্থা খারাপ, তার চেয়েও খারাপ মিউচুয়াল ফান্ডের অবস্থা। প্রতিটি মিউচুয়াল ফান্ডের মূল্য এখন NAV বা ইউনিটপ্রতি সম্পদের নিচে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ মূল্য NAV -এর ২০ থেকে ৩০ শতাংশ কম। এর অর্থ হলো, আস্থাহীনতা মিউচুয়াল ফান্ড মূল্যের ওপর চলছে! এর কারণ কী? কারণ হলো, অতীত থেকে মিউচুয়াল ফান্ডকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে এবং বড় ভুল হলো এগুলোকে শেয়ার বলে চালিয়ে দেয়া। অন্য ভুল ছিল, বাজারের লোকদের এটা বলা যে মিউচুয়াল ফান্ড নিরাপদ, এগুলো কিনলে ক্যাপিটাল লস হবে না। তৃতীয় ভুল ছিল, এগুলোকে স্পন্সরদের নামে অভিহিত করা এবং এভাবেই ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিকে আড়ালে রাখা। চতুর্থ ভুল, এগুলো কেনার জন্য ব্যাংকঋণের ব্যবস্থা করা। ফলে ১০ টাকার মিউচুয়াল ফান্ড বিক্রি হয়েছে ১০০ টাকার ওপর; অথচ তখনো ওই মিউচুয়াল ফান্ডের NAV ছিল ১০ টাকা। মিউচুয়াল ফান্ড নিয়ে এত বড় ভুল বিশ্বের অন্য কোথাও হয়েছে কি না জানি না। অন্য ভুলটি ছিল মিউচুয়াল ফান্ড থেকে বোনাস-রাইট ইউনিট ইস্যু করা যায় কি না, তা নিয়ে বিতর্ক তোলা এবং সেটাকে আদালতে নিয়ে যাওয়া।
মিউচুয়াল ফান্ডের ক্ষেত্রে অনেক অস্পষ্টতা ছিল এবং এখনো আছে। তবে শেয়ারবাজার ধসের পর সবার কিছুটা হুঁশ হয়েছে বলে মনে হয়। হুঁশটা রেগুলেটর এসইসির বেশি হলে ভালো হয়। তাদের ভুলের কারণেই ১০ টাকার NAV -এর মিউচুয়াল ফান্ড ১০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে এবং মিউচুয়াল ফান্ডকে নিয়ে এক ধরনের প্লেসমেন্ট বাণিজ্য হয়েছে। ওয়ারেন বাফেটের মিউচুয়াল ফান্ড প্রিমিয়ামে সেল হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে অতি অপরিচিত অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিগুলোর মিউচুয়াল ফান্ড কীভাবে প্রিমিয়ামে বিক্রি হলো? অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির মধ্যে আছে ICB AMC LTD, AIMS, RACE, LR Global, PFACMC এবং আরও কয়েকটি। মিউচুয়াল ফান্ডের কয়জন ক্রেতা এসব সম্পদ ম্যানেজমেন্টের নাম জানে? ৯৫ শতাংশ লোক জানেই না, সে যে মিউচুয়াল ফান্ডটি কিনেছে তা কোন অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি বা ফান্ড ম্যানেজার ব্যবস্থা করছে। বস্তুত এসব মিউচুয়াল ফান্ডের বাজারমূল্য বা ইউনিটপ্রতি NAV কত হবে, তা নির্ভর করছে ফান্ড ম্যানেজারদের দক্ষতার ওপর। সে জন্য বিদেশে ফান্ড ম্যানেজারদের Ranking হয় এবং মিউচুয়াল ফান্ডের Rating হয়। আমাদের অর্থনীতিতে এসবের বালাই নেই। এসইসি কোনো দিনই এমন একটা রেগুলেশন জারিও করেনি। অন্য বিষয়টি হলো, আমাদের এ বাজারে মিউচুয়াল ফান্ডের ক্রেতারা জানেই না যে, ফান্ড ম্যানেজার কীভাবে তার থেকে নেয় অর্থ ব্যবহার করেছে। মিউচুয়াল ফান্ডের পোর্টফলিওর ধরন ও প্রকৃতি সম্পর্কে ক্রেতা সম্পূর্ণ অন্ধকারে। ফলে সে বুঝতে পারে না কোন মিউচুয়াল ফান্ডের ভবিষ্যত্ ভালো। অন্য কথা হলো, যে সব সম্পদ ব্যবস্থাপক মানুষের কাছ থেকে ইউনিটপ্রতি ১০ টাকা নিয়ে এরই মধ্যে ২ টাকা হারিয়ে হাতে মাত্র ৮ টাকার সম্পদ নিয়ে বসে আছে, সেসব ফান্ড ম্যানেজার ম্যানেজমেন্ট ফি নেবে কেন? তাদের কি নৈতিক কোনো অধিকার আছে ১০ টাকার নিচে যেসব মিউচুয়াল ফান্ডের NAV নেমে গেছে, সেগুলো থেকে ফি নেয়ার? এসইসি এ ক্ষেত্রেও বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে। আয়েশা আকতার ফান্ড ম্যানেজারকে দিয়েছেন ১০ টাকা আর সেই ১০ টাকার মূল্য নেমে এসেছে ৮ টাকায়। এই হয়রানিটা কার দোষে হলো? তার পরও আয়েশা কেন ফান্ড ম্যানেজারকে ম্যানেজমেন্ট ফি দেবেন? একটা রেগুলেশন এমন হতে পারে যে, NAV ১০ টাকায় আসা পর্যন্ত কোনো রকম ম্যানেজমেন্ট ফি নেয়া যাবে না। অন্য বিষয়টি হলো, একেক ফান্ড ম্যানেজার একাধিক মিউচুয়াল ফান্ড ম্যানেজ করছে। ধরা যাক, তার অধীন পাঁচটি মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে দুটির অবস্থা বড়ই খারাপ, তিনটির অবস্থা ভালো। এখন যদি সে অন্তে মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর মধ্যে বেচাকেনা করে ভালো তিনটির বিনিময়ে খারাপ দুটিকে ভালো করে, তাহলে সেটা আইনি হবে কেন? আমি এসইসি কর্তৃক প্রকাশিত নীতিমালায় এ ব্যাপারে কোনো রেগুলেশন দেখলাম না। অন্য বিষয় হলো, সম্পদ ব্যবস্থাপকের যদি ব্যক্তিগত BO হিসাব থাকে বা তার পরিবারের লোকজনদের থাকে তাহলে এমনও তো হতে পারে যে, ব্যবস্থাপক নিজে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার জন্য মিউচুয়াল ফান্ড ও তার BO অ্যাকাউন্টের মধ্যে বেচাকেনা করল। এটাকে বলা হয় স্বার্থের সংঘাত। স্বার্থের সংঘাত যেখানেই আছে, সেখানেই রেগুলেটর এসইসি প্লেয়ারকে যেকোনো একটা কাজ করতে দেয়। প্রকাশিত মিউচুয়াল ফান্ড নীতিমালায় আমি এ ক্ষেত্রেও কোনো রকম বিধিনিষেধ দেখলাম না।
এটা অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, আমাদের এসইসি যতটা গুরুত্বের সঙ্গে মিউচুয়াল ফান্ডের উত্সগুলোকে দেখা দরকার সেটা দেখছে না। একদিন দেখা যাবে, মিউচুয়াল ফান্ড নিয়ে বড় রকমের কেলেঙ্কারি হচ্ছে। ৯৯ শতাংশ মিউচুয়াল ফান্ড ক্রেতা এটাও জানে না, ফান্ড ম্যানেজারদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, অন্য অভিজ্ঞতা এবং তাদের চরিত্রগত অবস্থান কী। এসইসির দায়িত্ব, তাদের ব্যাপারে জনগণকে জানতে দেয়া বাধ্যতামূলক করা।
যুক্তরাষ্ট্রের লোকেরা ওয়ারেন বাফেটকে যত সহজে অর্থ দেবে তাদের ফান্ড ম্যানেজ করার জন্য, ওয়ালস্ট্রিটের অন্য একজন টম-ডিক-হ্যারিকে কি না জেনে অর্থ দেবে? আমাদের বাজারে আমরা কেউ কিছু না জেনে যেমন শেয়ার কিনছি, তেমনি তার থেকে ঘোর বেশি অন্ধকারে থেকে মিউচুয়াল ফান্ডগুলো কিনছি। মিউচুয়াল ফান্ড থেকে প্রাপ্ত মুনাফা করমুক্ত হওয়া উচিত। কারণ মিউচুয়াল ফান্ডের লভ্যাংশের ওপর কর বসালে সেটা ডাবল ট্যাক্সসেশনের সমতুল্য হবে। এসইসির উচিত হবে, AMC -কে নতুন লাইসেন্স দিলে অত্যন্ত ভেবেচিন্তে দেয়া। এমনকি ট্রাস্টি বোর্ডকে অনুমোদন দিতেও অনেক যাচাই-বাচাই করতে হবে। সম্পদ ব্যবস্থাপক এবং ট্রাস্টি বোর্ড অবশ্যই সম্পূর্ণ আলাদা হতে হবে। ট্রাস্টির ক্ষমতা থাকতে হবে সম্পদ ব্যবস্থাপককে বদল করার। অন্য ইস্যু হলো, মিউচুয়াল ফান্ডগুলো হলো ক্লোজড অ্যান্ড-এর। কিন্তু ক্রেতারা জানে না কোন মিউচুয়াল ফান্ড কখন অবসায়িত হবে। এটা তো এসইসির দায়িত্ব End year টা সবাইকে জানিয়ে দেয়া। আমি এসইসিকে একটু চালাক হতে অনুরোধ করব। নইলে তারাও পুরনো এসইসির দোষে দুষ্ট হবে। শুধু অনুমোদন দেয়াই এসইসির কাজ নয়। কী অনুমোদন দেয়া হচ্ছে তা যদি এসইসি না দেখে তাহলে রেগুলেশন বলতে যা বোঝায় তার থেকে এসইসি বহু দূরেই থেকে যাবে।