শেয়ারবাজার :::: শিল্পপতিরা বলছেন, ব্যাংকে গিয়ে তাঁরা টাকা পাচ্ছেন না। আমদানিকারকদের অভিযোগ, তারল্য সংকটের কথা বলে ব্যাংকগুলো এলসি খুলছে না। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে যারা শিল্প ও সেবা খাতে অর্থায়ন করে, সেসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনুযোগ, ব্যাংক থেকে টাকা পাওয়া দুষ্কর।
কিন্তু তথ্য-উপাত্ত বলছে অন্য কথা। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর হাতে বর্তমানে ২৮ হাজার কোটি টাকা উদ্বৃত্ত তারল্য আছে, অলস পড়ে আছে দুই হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের দাবি, ব্যাংক খাতে কোনো তারল্য সংকট নেই। অপরিণামদর্শী ও অনুমাননির্ভর বিনিয়োগের কারণে সংকটে পড়েছে কিছু ব্যাংক। সে দায় তারা চাপাতে চাইছে সমগ্র ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর। আর তার খেসারত দিতে হচ্ছে ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তাদের।
তথাকথিত তারল্য সংকট থেকে উত্তরণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে দেন-দরবার ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর দ্বারস্থ হয়েছিলেন ব্যাংক খাতের উদ্যোক্তারা। একপর্যায়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণের সুদহারের সর্বোচ্চ সীমা তুলে নেয়। এতে ব্যাংকগুলোর ঋণের সুদ বেড়ে যায়, যা বিনিয়োগ ও আমদানি বাণিজ্যেও প্রভাব ফেলে। ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করছেন, গত ৯ মার্চ সুদের হারের সীমা তুলে নেওয়ার পর ব্যাংকগুলো তাঁদের কাছ থেকে ১৮ শতাংশ পর্যন্ত সুদ আদায় করছে। গত রবিবার এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, ক্রমাগত উচ্চসুদ ও তারল্য সংকট বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রবল প্রতিবন্ধকতা আরোপ করে অর্থনীতিকে আশঙ্কাজনকভাবে স্তিমিত করে তুলছে। এর ফলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ নিরুৎসাহ হচ্ছে।
অন্যদিকে ঋণের সুদহার বাড়ানোর পর আমানতের সুদ হার বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছে ব্যাংকগুলো। আকর্ষণীয় হারে স্থায়ী আমানত সংগ্রহ করছে তারা। অতীতে সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক আমানতের সুদহার কমিয়ে মানুষকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছিল। এখন আবার আমানতের সুদহার বাড়িয়ে ব্যাংকগুলো মানুষকে পুঁজিবাজার থেকে ফিরিয়ে নেওয়ার আয়োজন করছে বলে অভিযোগ করছেন শেয়ারবাজার-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, কিছু ব্যাংকের সীমাতিরিক্ত বিনিয়োগের কারণে তাদের ঋণ আমানত অনুপাত হঠাৎ বেড়ে যায়।
পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এসব ব্যাংককে ঋণ আমানত অনুপাত জুনের মধ্যে ৮৫ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনার নির্দেশ দেয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকগুলো তাদের নতুন করে ঋণ সম্প্রসারণ বন্ধ করে দেয়। এমনকি পুরনো ঋণের বিপরীতে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল দেওয়ার ক্ষেত্রেও তারল্য সংকটের দোহাই দিয়ে বিলম্বিত করতে থাকে। এ প্রক্রিয়ায় ঋণ আমানত অনুপাত কমলেও ব্যবসায়ীরা যথাসময়ে তাঁদের ব্যবসার জন্য প্রয়োজনীয় ঋণ পাচ্ছেন না। ফলে এক অর্থে তাঁদের ব্যাংকারদের পাপের দায়ের খেসারত দিতে হচ্ছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত একটি প্রতিষ্ঠান বিনা নোটিশে প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি টাকা তুলে নেওয়ায় একসময় ঋণ আমানত অনুপাত ১০০ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। বর্তমানে ব্যাংকটির ঋণ আমানত অনুপাত প্রায় ৮৮ শতাংশে নেমে এসেছে। ব্যাংকটির ঋণ সম্প্রসারণ কমিয়ে দিয়ে আমানত বাড়ানোর পরিপ্রেক্ষিতেই এ ঋণ আমানত অনুপাত কমে এসেছে।
এ বিষয়ে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চু কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এ মুহূর্তে আমাদের কোনো তারল্য সংকট নেই। তবে আমরা দেখেশুনেই ঋণ সম্প্রসারণ করছি। আমানত সংগ্রহ করছি, কিন্তু আমরা উচ্চসুদের বিনিময়ে আমানত সংগ্রহ করছি না। কিছুদিন আগেও আমাদের কলমানি থেকে ধার করতে হয়েছে। এখন আমরা কলমানিতে উল্টো অন্য ব্যাংককে ধার দিচ্ছি।'
বেসিক ব্যাংকের তারল্য সংকটের নেপথ্যে ছিল একটি দুর্ঘটনা (বিনা নোটিশে প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি টাকা চলে যাওয়া)। কিন্তু যেসব ব্যাংক তারল্য সংকটে পড়েছিল, তাদের বেশির ভাগই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ আটকে যাওয়ার কারণে সংকটে পতিত হয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে উচ্চ সুদের বিনিময়ে আমানত সংগ্রহ করে এবং ঋণ সম্প্রসারণ প্রায় বন্ধ রেখে এসব ব্যাংক তাদের ঋণ আমানত অনুপাত কমিয়ে আনছে।
সাম্প্রতিক ব্যাংকার্স সভা শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর নজরুল হুদাও তারল্য সংকট নেই_এ কথা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, আমদানি-রপ্তানি বাড়ায় তারল্যের ওপর চাপ আছে। তবে কয়েকটি ব্যাংক ছাড়া সামগ্রিকভাবে ব্যাংকিং সিস্টেমে তারল্য সংকট নেই। বর্তমানে ২৮ হাজার কোটি টাকা উদ্বৃত্ত তারল্য আছে, অলস টাকা পড়ে আছে দুই হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া রপ্তানির যে ২০০ কোটি ডলার আটকে আছে, তা চার মাসের পরিবর্তে কিভাবে আরো তাড়াতাড়ি দেশে ফেরত আনা যায়, সেই বিষয়েও ব্যাংকগুলোকে বলা হয়েছে। এ টাকা বাজারে এলে তারল্যের ওপর যে চাপ আছে, তা কমে যাবে।
নজরুল হুদার এমন দাবির সমর্থন করে তখন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) সভাপতি কে মাহমুদ সাত্তার বলেন, সামগ্রিকভাবে ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট নেই। তবে যেসব ব্যাংকের সিডিআর এখনো নির্দিষ্ট সীমার বাইরে আছে, তারা সেটি সীমার মধ্যে নামিয়ে আনতে এলসিসহ যেকোনো নতুন বিনিয়োগে যাচ্ছে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ব্যাংকগুলো পুঁজিবাজারসহ আরো দু-একটি স্পেকুলেটিভ খাতে বিনিয়োগ আটকে পড়ার অজুহাতকে আড়াল করতেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নগদ জমা সংরক্ষণ (সিআরআর) বাড়ানোকে দায়ী করে। কিন্তু এ বিষয়ে পুঁজিবাজারের সাম্প্রতিক বিপর্যয়ের কারণ অনুসন্ধানে গঠিত কমিটির কাছে দেওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে প্রকৃত সত্য প্রকাশ পায়।
বিনিয়োগ আটকে যায় পুঁজিবাজারে : বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই প্রতিবেদন থেকে দেখা গেছে, ৩০ ডিসেম্বর ২০১০ তারিখে পুঁজিবাজারে মোট বিনিয়োগ ছিল তিন লাখ ৫০ হাজার ৮০০ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। এতে ব্যাংকগুলোর সরাসরি বিনিয়োগ ছিল ১০ হাজার ৫৪৭ কোটি ৫২ লাখ টাকা এবং ঋণ হিসেবে বিনিয়োগ ছিল এক হাজার ৯৯৩ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। ৩১ ডিসেম্বর তারিখে পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর মোট বিনিয়োগ ছিল ১২ হাজার ৫৪১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।
এ বিপুল পরিমাণ অর্থ আটকে যাওয়ার কারণেই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারী ব্যাংকগুলোর ঋণ আমানত অনুপাত বেড়ে যায় এবং তারল্য সংকট দেখা দেয়। এ ছাড়া কিছু ব্যাংক পুঁজিবাজারে ধস নামার আগেই কলমানি থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ধার করে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
ঝুঁকিতে মার্চেন্ট ব্যাংকিং উইং : প্রায় সব ব্যাংকের মার্চেন্ট ব্যাংকিং উইংগুলো পুঁজিবাজারে মার্জিন ঋণ দিয়েছে। এর রেশিও কখনো ছিল ১ অনুপাত ১ আবার কখনো ১ অনুপাত ২। এ ক্ষেত্রে এসইসির মার্জিন রুলের বড় ধরনের লঙ্ঘন হয়েছে বলে প্রমাণ পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এসব লঙ্ঘনের কারণেই পুঁজিবাজারে ট্রিগার সেলে যেতে পারছে না অনেক ব্যাংক। কারণ এতে গ্রাহকের এক টাকা লোকসানের বিপরীতে কোনো কোনো মার্চেন্ট ব্যাংকারের তিন থেকে চার টাকা লোকসান হতে পারে।
এতে মার্জিন রুলের লঙ্ঘন হলেও এসইসি কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। অন্যদিকে ২০০০ সালের ২৩ অক্টোবর অর্থ মন্ত্রণালয় একটি গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে মার্চেন্ট ব্যাংকিং উইংগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংকের মনিটরিং থেকে অব্যাহতি প্রদান করায় এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকেরও করণীয় কিছু ছিল না।
সিআরআর বাড়ানোয় তারল্য সংকট হয়নি : প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১০ সালের আগস্টে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক রেপো ও রিভার্স রেপোর রেট ১০০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে দেয়, যা ব্যাংকগুলোর জন্য সংকোচনমুখী মুদ্রানীতির আগাম আভাস ছিল। এতেও সংযত হয়নি ব্যাংকগুলো, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ অবলম্বন ছিল নগদ জমা সংরক্ষণ বাড়ানো।
অবশেষে ১ ডিসেম্বর ১৫ দিন সময় দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক দশমিক ৫ শতাংশ সিআরআর বাড়িয়ে দেয়। এতে সাধারণ ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে এক হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা এবং ইসলামী ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ৩০৭ কোটি টাকাসহ সর্বমোট এক হাজার ৭৭১ কোটি টাকা ব্যাংকিং খাত থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তুলে নেয়। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিদিনই প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা তারল্য সহায়তা ও রেপো অব্যাহত রাখে। ফলে তারল্য সংকট সিআরআর বাড়ানোর কারণে সৃষ্টি হয়নি, তা স্পষ্ট।
কলমানির গ্রহীতারা এখন দাতা : গত বছরের ১৫ ডিসেম্বরে ১১টি ব্যাংক সর্বোচ্চ ১৫০ শতাংশ রেটেও কলমানি থেকে টাকা ধার করেছে। এগুলো হচ্ছে ব্যাংক আল-ফালাহ, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, এবি ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ও দি সিটি ব্যাংক লিমিটেড। কিন্তু এখন ব্যাংকগুলোর তারল্য পরিস্থিতি অনেক স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। গত ১৮ মে ব্যাংক আল-ফালাহ ৪৮ কোটি টাকা ধার দিয়েছে। এ ছাড়া ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ৩১৪ কোটি টাকা, ইস্টার্ন ব্যাংক ১৬০ কোটি টাকা, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ২৫ কোটি টাকা, পূবালী ব্যাংক ২৪৫ কোটি টাকা, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ৯৮ কোটি টাকা অন্য ব্যাংককে ধার দিয়েছে। কলমানিতে সংকটের সময় এবি ব্যাংক গড়পড়তা ২৫০ কোটি টাকা ধারকারী ব্যাংক হলেও বর্তমানে ব্যাংকটির ধারের পরিমাণ অনেক কমে এসেছে। ১৮ মে ব্যাংকটি মাত্র ১১০ কোটি টাকা ধার করেছে। এসব ব্যাংকের প্রতিটিরই ঋণ আমানত অনুপাতও কমেছে।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা বারবার বলেছি, সিআরআর বাড়ানোর কারণে ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট দেখা দেয়নি। আমরা যে পরিমাণ অর্থ সিআরআর বাড়ানোর মাধ্যমে তুলে নিয়েছিলাম, তার চেয়ে বেশি তারল্য বাজারে ছেড়েছি।'
সিআরআর বাড়ানো এবং একই সঙ্গে তারল্য সরবরাহ অব্যাহত রাখা সাংঘর্ষিক কি না_এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, না, সাংঘর্ষিক নয়। সিআরআর একটি দীর্ঘ মেয়াদি প্রক্রিয়া। এর টাকা দীর্ঘ মেয়াদে অর্থাৎ পরবর্তী সিদ্ধান্ত না নেওয়া পর্যন্ত বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয়। এতে দীর্ঘ মেয়াদে একটা প্রভাব পড়ে। অন্যদিকে রেপো ও তারল্য সহায়তার অর্থ প্রতিদিন ভিত্তিতে বাজারে ছাড়া হয় এবং তা আবার যথাসময়ে তুলে নেওয়া যায়। অর্থাৎ নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতেই থাকে। তাই কোনোভাবেই এ দুটি সিদ্ধান্ত সাংঘর্ষিক নয়। এ ছাড়া ব্যাংকগুলো যে হারে লাগামহীনভাবে বিনিয়োগ শুরু করেছিল, তার রেশ টেনে ধরাও প্রয়োজন ছিল
কিন্তু তথ্য-উপাত্ত বলছে অন্য কথা। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর হাতে বর্তমানে ২৮ হাজার কোটি টাকা উদ্বৃত্ত তারল্য আছে, অলস পড়ে আছে দুই হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের দাবি, ব্যাংক খাতে কোনো তারল্য সংকট নেই। অপরিণামদর্শী ও অনুমাননির্ভর বিনিয়োগের কারণে সংকটে পড়েছে কিছু ব্যাংক। সে দায় তারা চাপাতে চাইছে সমগ্র ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর। আর তার খেসারত দিতে হচ্ছে ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তাদের।
তথাকথিত তারল্য সংকট থেকে উত্তরণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে দেন-দরবার ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর দ্বারস্থ হয়েছিলেন ব্যাংক খাতের উদ্যোক্তারা। একপর্যায়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণের সুদহারের সর্বোচ্চ সীমা তুলে নেয়। এতে ব্যাংকগুলোর ঋণের সুদ বেড়ে যায়, যা বিনিয়োগ ও আমদানি বাণিজ্যেও প্রভাব ফেলে। ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করছেন, গত ৯ মার্চ সুদের হারের সীমা তুলে নেওয়ার পর ব্যাংকগুলো তাঁদের কাছ থেকে ১৮ শতাংশ পর্যন্ত সুদ আদায় করছে। গত রবিবার এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, ক্রমাগত উচ্চসুদ ও তারল্য সংকট বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রবল প্রতিবন্ধকতা আরোপ করে অর্থনীতিকে আশঙ্কাজনকভাবে স্তিমিত করে তুলছে। এর ফলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ নিরুৎসাহ হচ্ছে।
অন্যদিকে ঋণের সুদহার বাড়ানোর পর আমানতের সুদ হার বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছে ব্যাংকগুলো। আকর্ষণীয় হারে স্থায়ী আমানত সংগ্রহ করছে তারা। অতীতে সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক আমানতের সুদহার কমিয়ে মানুষকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছিল। এখন আবার আমানতের সুদহার বাড়িয়ে ব্যাংকগুলো মানুষকে পুঁজিবাজার থেকে ফিরিয়ে নেওয়ার আয়োজন করছে বলে অভিযোগ করছেন শেয়ারবাজার-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, কিছু ব্যাংকের সীমাতিরিক্ত বিনিয়োগের কারণে তাদের ঋণ আমানত অনুপাত হঠাৎ বেড়ে যায়।
পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এসব ব্যাংককে ঋণ আমানত অনুপাত জুনের মধ্যে ৮৫ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনার নির্দেশ দেয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকগুলো তাদের নতুন করে ঋণ সম্প্রসারণ বন্ধ করে দেয়। এমনকি পুরনো ঋণের বিপরীতে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল দেওয়ার ক্ষেত্রেও তারল্য সংকটের দোহাই দিয়ে বিলম্বিত করতে থাকে। এ প্রক্রিয়ায় ঋণ আমানত অনুপাত কমলেও ব্যবসায়ীরা যথাসময়ে তাঁদের ব্যবসার জন্য প্রয়োজনীয় ঋণ পাচ্ছেন না। ফলে এক অর্থে তাঁদের ব্যাংকারদের পাপের দায়ের খেসারত দিতে হচ্ছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত একটি প্রতিষ্ঠান বিনা নোটিশে প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি টাকা তুলে নেওয়ায় একসময় ঋণ আমানত অনুপাত ১০০ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। বর্তমানে ব্যাংকটির ঋণ আমানত অনুপাত প্রায় ৮৮ শতাংশে নেমে এসেছে। ব্যাংকটির ঋণ সম্প্রসারণ কমিয়ে দিয়ে আমানত বাড়ানোর পরিপ্রেক্ষিতেই এ ঋণ আমানত অনুপাত কমে এসেছে।
এ বিষয়ে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চু কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এ মুহূর্তে আমাদের কোনো তারল্য সংকট নেই। তবে আমরা দেখেশুনেই ঋণ সম্প্রসারণ করছি। আমানত সংগ্রহ করছি, কিন্তু আমরা উচ্চসুদের বিনিময়ে আমানত সংগ্রহ করছি না। কিছুদিন আগেও আমাদের কলমানি থেকে ধার করতে হয়েছে। এখন আমরা কলমানিতে উল্টো অন্য ব্যাংককে ধার দিচ্ছি।'
বেসিক ব্যাংকের তারল্য সংকটের নেপথ্যে ছিল একটি দুর্ঘটনা (বিনা নোটিশে প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি টাকা চলে যাওয়া)। কিন্তু যেসব ব্যাংক তারল্য সংকটে পড়েছিল, তাদের বেশির ভাগই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ আটকে যাওয়ার কারণে সংকটে পতিত হয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে উচ্চ সুদের বিনিময়ে আমানত সংগ্রহ করে এবং ঋণ সম্প্রসারণ প্রায় বন্ধ রেখে এসব ব্যাংক তাদের ঋণ আমানত অনুপাত কমিয়ে আনছে।
সাম্প্রতিক ব্যাংকার্স সভা শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর নজরুল হুদাও তারল্য সংকট নেই_এ কথা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, আমদানি-রপ্তানি বাড়ায় তারল্যের ওপর চাপ আছে। তবে কয়েকটি ব্যাংক ছাড়া সামগ্রিকভাবে ব্যাংকিং সিস্টেমে তারল্য সংকট নেই। বর্তমানে ২৮ হাজার কোটি টাকা উদ্বৃত্ত তারল্য আছে, অলস টাকা পড়ে আছে দুই হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া রপ্তানির যে ২০০ কোটি ডলার আটকে আছে, তা চার মাসের পরিবর্তে কিভাবে আরো তাড়াতাড়ি দেশে ফেরত আনা যায়, সেই বিষয়েও ব্যাংকগুলোকে বলা হয়েছে। এ টাকা বাজারে এলে তারল্যের ওপর যে চাপ আছে, তা কমে যাবে।
নজরুল হুদার এমন দাবির সমর্থন করে তখন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) সভাপতি কে মাহমুদ সাত্তার বলেন, সামগ্রিকভাবে ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট নেই। তবে যেসব ব্যাংকের সিডিআর এখনো নির্দিষ্ট সীমার বাইরে আছে, তারা সেটি সীমার মধ্যে নামিয়ে আনতে এলসিসহ যেকোনো নতুন বিনিয়োগে যাচ্ছে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ব্যাংকগুলো পুঁজিবাজারসহ আরো দু-একটি স্পেকুলেটিভ খাতে বিনিয়োগ আটকে পড়ার অজুহাতকে আড়াল করতেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নগদ জমা সংরক্ষণ (সিআরআর) বাড়ানোকে দায়ী করে। কিন্তু এ বিষয়ে পুঁজিবাজারের সাম্প্রতিক বিপর্যয়ের কারণ অনুসন্ধানে গঠিত কমিটির কাছে দেওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে প্রকৃত সত্য প্রকাশ পায়।
বিনিয়োগ আটকে যায় পুঁজিবাজারে : বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই প্রতিবেদন থেকে দেখা গেছে, ৩০ ডিসেম্বর ২০১০ তারিখে পুঁজিবাজারে মোট বিনিয়োগ ছিল তিন লাখ ৫০ হাজার ৮০০ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। এতে ব্যাংকগুলোর সরাসরি বিনিয়োগ ছিল ১০ হাজার ৫৪৭ কোটি ৫২ লাখ টাকা এবং ঋণ হিসেবে বিনিয়োগ ছিল এক হাজার ৯৯৩ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। ৩১ ডিসেম্বর তারিখে পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর মোট বিনিয়োগ ছিল ১২ হাজার ৫৪১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।
এ বিপুল পরিমাণ অর্থ আটকে যাওয়ার কারণেই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারী ব্যাংকগুলোর ঋণ আমানত অনুপাত বেড়ে যায় এবং তারল্য সংকট দেখা দেয়। এ ছাড়া কিছু ব্যাংক পুঁজিবাজারে ধস নামার আগেই কলমানি থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ধার করে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
ঝুঁকিতে মার্চেন্ট ব্যাংকিং উইং : প্রায় সব ব্যাংকের মার্চেন্ট ব্যাংকিং উইংগুলো পুঁজিবাজারে মার্জিন ঋণ দিয়েছে। এর রেশিও কখনো ছিল ১ অনুপাত ১ আবার কখনো ১ অনুপাত ২। এ ক্ষেত্রে এসইসির মার্জিন রুলের বড় ধরনের লঙ্ঘন হয়েছে বলে প্রমাণ পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এসব লঙ্ঘনের কারণেই পুঁজিবাজারে ট্রিগার সেলে যেতে পারছে না অনেক ব্যাংক। কারণ এতে গ্রাহকের এক টাকা লোকসানের বিপরীতে কোনো কোনো মার্চেন্ট ব্যাংকারের তিন থেকে চার টাকা লোকসান হতে পারে।
এতে মার্জিন রুলের লঙ্ঘন হলেও এসইসি কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। অন্যদিকে ২০০০ সালের ২৩ অক্টোবর অর্থ মন্ত্রণালয় একটি গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে মার্চেন্ট ব্যাংকিং উইংগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংকের মনিটরিং থেকে অব্যাহতি প্রদান করায় এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকেরও করণীয় কিছু ছিল না।
সিআরআর বাড়ানোয় তারল্য সংকট হয়নি : প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১০ সালের আগস্টে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক রেপো ও রিভার্স রেপোর রেট ১০০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে দেয়, যা ব্যাংকগুলোর জন্য সংকোচনমুখী মুদ্রানীতির আগাম আভাস ছিল। এতেও সংযত হয়নি ব্যাংকগুলো, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ অবলম্বন ছিল নগদ জমা সংরক্ষণ বাড়ানো।
অবশেষে ১ ডিসেম্বর ১৫ দিন সময় দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক দশমিক ৫ শতাংশ সিআরআর বাড়িয়ে দেয়। এতে সাধারণ ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে এক হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা এবং ইসলামী ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ৩০৭ কোটি টাকাসহ সর্বমোট এক হাজার ৭৭১ কোটি টাকা ব্যাংকিং খাত থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তুলে নেয়। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিদিনই প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা তারল্য সহায়তা ও রেপো অব্যাহত রাখে। ফলে তারল্য সংকট সিআরআর বাড়ানোর কারণে সৃষ্টি হয়নি, তা স্পষ্ট।
কলমানির গ্রহীতারা এখন দাতা : গত বছরের ১৫ ডিসেম্বরে ১১টি ব্যাংক সর্বোচ্চ ১৫০ শতাংশ রেটেও কলমানি থেকে টাকা ধার করেছে। এগুলো হচ্ছে ব্যাংক আল-ফালাহ, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, এবি ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ও দি সিটি ব্যাংক লিমিটেড। কিন্তু এখন ব্যাংকগুলোর তারল্য পরিস্থিতি অনেক স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। গত ১৮ মে ব্যাংক আল-ফালাহ ৪৮ কোটি টাকা ধার দিয়েছে। এ ছাড়া ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ৩১৪ কোটি টাকা, ইস্টার্ন ব্যাংক ১৬০ কোটি টাকা, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ২৫ কোটি টাকা, পূবালী ব্যাংক ২৪৫ কোটি টাকা, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ৯৮ কোটি টাকা অন্য ব্যাংককে ধার দিয়েছে। কলমানিতে সংকটের সময় এবি ব্যাংক গড়পড়তা ২৫০ কোটি টাকা ধারকারী ব্যাংক হলেও বর্তমানে ব্যাংকটির ধারের পরিমাণ অনেক কমে এসেছে। ১৮ মে ব্যাংকটি মাত্র ১১০ কোটি টাকা ধার করেছে। এসব ব্যাংকের প্রতিটিরই ঋণ আমানত অনুপাতও কমেছে।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা বারবার বলেছি, সিআরআর বাড়ানোর কারণে ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট দেখা দেয়নি। আমরা যে পরিমাণ অর্থ সিআরআর বাড়ানোর মাধ্যমে তুলে নিয়েছিলাম, তার চেয়ে বেশি তারল্য বাজারে ছেড়েছি।'
সিআরআর বাড়ানো এবং একই সঙ্গে তারল্য সরবরাহ অব্যাহত রাখা সাংঘর্ষিক কি না_এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, না, সাংঘর্ষিক নয়। সিআরআর একটি দীর্ঘ মেয়াদি প্রক্রিয়া। এর টাকা দীর্ঘ মেয়াদে অর্থাৎ পরবর্তী সিদ্ধান্ত না নেওয়া পর্যন্ত বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয়। এতে দীর্ঘ মেয়াদে একটা প্রভাব পড়ে। অন্যদিকে রেপো ও তারল্য সহায়তার অর্থ প্রতিদিন ভিত্তিতে বাজারে ছাড়া হয় এবং তা আবার যথাসময়ে তুলে নেওয়া যায়। অর্থাৎ নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতেই থাকে। তাই কোনোভাবেই এ দুটি সিদ্ধান্ত সাংঘর্ষিক নয়। এ ছাড়া ব্যাংকগুলো যে হারে লাগামহীনভাবে বিনিয়োগ শুরু করেছিল, তার রেশ টেনে ধরাও প্রয়োজন ছিল