,

ক্ষতিগ্রস্ত চামড়া ঠিক করুন নিমিষে- Burnt Skin repairing system discovered

Saturday, October 19, 2013 Other
প্রোটিন থেকে এমন এক চিকিৎসা পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন, যার মাধ্যমে আগুনে পুড়ে ও রাসায়নিক কারণে ক্ষতিগ্রস্ত রোগীর ত্বক ও মাংসপেশির দ্রুত আরোগ্য সম্ভব। স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১০ সালে পেয়েছেন নিউজিল্যান্ডের বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্য বিভাগের সর্বোচ্চ সম্মাননা 'বেয়ার ইনোভেটর্স' পুরস্কার। পাশাপাশি বেশ কয়েকটি মূল্যবান বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও উদ্ভাবনের আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব রয়েছে ড. আজম আলীর নামে। এখন নিউজিল্যান্ড সরকারের 'ন্যাশনাল সায়েন্স চ্যালেঞ্জ প্রোগ্রাম'-এ কাজ করছেন এই বিজ্ঞানী। তাঁকে নিয়েই আজকের স্পটলাইটলেখা ও সাক্ষাৎকার : সাকিব সিকান্দার নতুন ক্লাসের কড়কড়ে ভাঁজহীন সব বইয়ের মধ্যে বিজ্ঞান বইগুলো খুব দ্রুতই মলিন হয়ে যেত আজম আলীর। 'বিশেষ জ্ঞান'-এর বিস্ময়কর বিষয়গুলো জানার নেশায় সময় কাটত তাঁর। তাই সে শহরে গিয়ে লাইব্রেরিতে বিজ্ঞানবিষয়ক বই সংগ্রহে ব্যস্ত থাকত। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার অত্যাচারে অতিষ্ঠ থাকতেন মা। আর এসব কাণ্ড-কারখানা দেখে ছেলের নামের সঙ্গে 'ক্ষুদে বিজ্ঞানী'র তকমাটা জুড়ে দিয়েছিলেন বাবা এবং বলতেন, দেখো একদিন তোমার এই ছেলে বড় বিজ্ঞানী হবে। তখন কে জানত, একদিন সত্যি সত্যিই পৃথিবীর খ্যাতিমান বিজ্ঞানীদের তালিকায় লেখা হবে সেই বিজ্ঞানপাগল ছেলেটির নাম! বিশ্বের বিজ্ঞানী মহলে আজ পরিচিত নাম ড. আজম আলী। চিকিৎসাবিজ্ঞানের একটি অংশকে বহুদূর এগিয়ে নিয়েছেন জৈবরসায়নের এই জাদুকর। আজম আলীর উদ্ভাবন নিউজিল্যান্ডের ভেড়ার লোমে এক ধরনের প্রোটিন রয়েছে। এই প্রোটিনকে বলে কেরোটিন। এটিকে কাজে লাগিয়ে ক্ষত নিরাময়ের প্রযুক্তি ও ওষুধ উদ্ভাবন করেন ড. আজম। প্রথমে তিনি ভেড়ার লোম থেকে কেরোটিন নামের এ প্রোটিনকে বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে নতুন ধরনের এবং ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের জৈব প্রোটিন তৈরি করেন। উদ্ভাবিত নতুন এ পদার্থের চরিত্র ও আচরণ সম্পূর্ণ মৌলিক। এর ওপর বিজ্ঞানের আরো কিছু পরীক্ষা ফলিয়ে তৈরি করেন ক্ষতের চিকিৎসার সেই প্রযুক্তি ও ওষুধ। এসিডে ঝলসে যাওয়ায় বা আগুনে পুড়ে মানুষের চামড়ায় যে মারাত্মক ক্ষত হয়, তার ওষুধ হিসেবে এত দিন যে ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা হতো, ড. আজম আলীর ওষুধটি কাজ করে তার চেয়ে ৪০ গুণ দ্রুত। এ ছাড়া প্রচলিত ওষুধ তৈরি হয় মানুষ বা শূকরের কোলাজেন বা চর্বি থেকে, যা অনেক দেশেই ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। ড. আজমের ওষুধটি চামড়ার টিস্যুর সঙ্গে এমনভাবে কাজ করে যে তা অতি দ্রুত টিস্যুকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়। টিস্যু ছাড়াও মাংসপেশির একই ধরনের জখমে এই বিশেষ জৈব প্রোটিন চামড়ার বিক্ষত চেহারাটিকে আগের মতোই করে দেয়। অন্যদিকে প্রচলিত ওষুধ শুধু ক্ষতের উপরিভাগ নিরাময় করে। ক্ষতিগ্রস্ত টিস্যু বা চামড়ার অন্য অংশ আগের সৌন্দর্য সহজে ফিরে পায় না। ড. আজমের উদ্ভাবিত এ ধরনের দুটি প্রযুক্তি ও ওষুধ ইতিমধ্যে আমেরিকা, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াসহ গোটা ইউরোপে নিজ নিজ দেশের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিভাগের স্বীকৃতি পেয়েছে। এ ছাড়া মানুুষের হাড় প্রতিস্থাপন বা জোড়া লাগানোর জন্য আজম আলীর গবেষণালব্ধ কিছু উদ্ভাবন পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে। এখানেও তাঁর জাদুকরী উদ্ভাবন দেখার অপেক্ষায় রয়েছে চিকিৎসাবিজ্ঞান। জৈবরসায়ন বিশেষজ্ঞ আজম আলী জৈবরসায়নবিদ। বিভিন্ন জৈবিক পদার্থ থেকে মানুষের চিকিৎসাসহ নানা কাজে প্রয়োজনীয় নতুন পদার্থ উদ্ভাবনে সিদ্ধহস্ত তিনি। তাঁর কাজের পরিধিতে রয়েছে বায়োপলিমার এবং প্রোটিন কেমিস্ট্রি, পলিমার ও ম্যাটারিয়ালস সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, বায়োম্যাটারিয়ালস, ন্যানোবিজ্ঞান, ন্যানোপ্রযুক্তি ইত্যাদি। চিকিৎসার নানা জৈবযন্ত্রপাতি তৈরি, বায়োসেন্সর এবং বায়োম্যাটারিয়ালস ও বায়োলজিকের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ, চরিত্রগত পরিবর্তন, নতুন বৈশিষ্ট্য প্রদান এবং নিয়মিত মান নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কাজ করেন তিনি। পাশাপাশি ম্যাটারিয়ালস এবং বায়োম্যাটারিয়ালসের চরিত্রগত ভিন্ন বৈশিষ্ট্য প্রদানসহ এসব বিষয়ে বৃহৎ পরিসরে প্রকল্প তৈরি, অবকাঠামো গড়ে তোলা, যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা এবং নেতৃত্ব প্রদান করে থাকেন ড. আজম। যে জীবন গবেষকের বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব ওটাগোর ডানেডিন ক্যাম্পাসে কাজ করছেন ড. আজম। এর আগে নিউজিল্যান্ডের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞান গবেষণামূলক সরকারি প্রতিষ্ঠান ক্রাউন রিসার্চ ইনস্টিটিউটে (এজি রিসার্চ) কাজ করেছেন। ২০০৩ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত টানা ১০ বছর। এজি রিসার্চ ছাড়ার আগে তিনি জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী হিসেবে বায়োম্যাটারিয়াল এবং ন্যানোটেকনোলজি বিভাগের বিজ্ঞানী দলের প্রধান পদে দায়িত্বরত ছিলেন। ২০০৩ থেকে ২০০৭-এর জানুয়ারি পর্যন্ত উল রিসার্চ অর্গানাইজেশনে জৈবরসায়নের বায়োম্যাটারিয়ালস নিয়ে গবেষণা দলের প্রধান হয়ে কাজ করেছেন। পিএইচডি শেষ করেই ২০০০ সালে পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চ ফেলো হিসেবে যোগ দেন পোহাং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে। একই বছরের অক্টোবরে আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলিনায় রসায়ন বিভাগের পোস্ট ডক্টরাল ফেলো হিসেবে গবেষণা শুরু করেন এবং ২০০৩-এর জুলাই পর্যন্ত কাজ করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ন্যানোফটোরেজিস্ট সিনথেসিস, ফটোলিথোগ্রাফি, পলিমার বা বায়োপলিমেরিক বায়োম্যাটারিয়ালসের উন্নয়ন, টিস্যু ইঞ্জিনিয়ারিং, ম্যাটারিয়ালস এবং বায়োম্যাটারিয়ালের চরিত্র নির্ণয় এবং এগুলোর নতুন বৈশিষ্ট্য নিয়ে জটিল সব গবেষণা করেন। এ ছাড়া মালয়েশিয়ার পাম অয়েল বোর্ড, জাপানের জায়েরি (জেএইআরআই), দক্ষিণ কোরিয়ার পোসটেকে (পিওএসটিইসিএইচ) কাজ করেছেন এই বিজ্ঞানী। 'বেয়ার ইনোভেটর্স' ও অন্যান্য সম্মাননা ২০১০ সালের ২৪ আগস্ট নিউজিল্যান্ডের এজি রিসার্চে কর্মরত থাকাকালীন বিখ্যাত 'বেয়ার ইনোভেটর্স' পুরস্কারে ভূষিত হন ড. আজম। বিজ্ঞানে বিশেষ অবদানের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিতে অত্যন্ত সম্মানজনক একটি পুরস্কার এটি। পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে এজি রিসার্চের ফুড ও টেক্সটাইল বিভাগের জেনারেল ম্যানেজার এবং তাঁরই এক সহকর্মী বলেন, 'মানুষের কল্যাণে আজমের বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও আবিষ্কার এ পৃথিবীতে অতুলনীয়। তাঁর গবেষণা পদ্ধতি এবং এর সুফল প্রমাণ করেছে, বিজ্ঞান শুধু মানুষের উপকারেই নয়; বরং একটি দেশের বাণিজ্যিক ক্ষেত্রও গতিশীল করতে পারে। তাঁর এ উদ্ভাবনে সম্ভাবনাময় হয়ে উঠেছে নিউজিল্যান্ডের উলশিল্পটি।' নিজের কাজের জন্য পেয়েছেন অনেক সম্মাননা। এর মধ্যে ২০০৩ সালে এনসিবিসি (ইউএস) রিসার্চ ফেলোশিপ, ২০০১ সালে ডিওডি (ইউএস) রিসার্চ ফেলোশিপ, ২০০০ সালে ব্রেইন কোরিয়া কে-২০ ফেলোশিপ, ১৯৯৯ সালে মালয়েশিয়ান প্রাইমারি ইন্ডাস্ট্রি সিলভার মেডেল, ১৯৯৭ সালে মালয়েশিয়ান পাম অয়েল বোর্ড ফেলোশিপ এবং ১৯৮৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর চ্যান্সেলর স্কলারশিপের অধিকারী তিনি। পাশাপাশি চিকিৎসাবিজ্ঞানে তাঁর গবেষণালব্ধ লেখাগুলো বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। বিজ্ঞানী হিসেবে যুক্ত হয়েছেন অনেক আন্তর্জাতিক সংগঠনে। অস্ট্রেলিয়ান সোসাইটি ফর বায়োম্যাটারিয়ালস অ্যান্ড টিস্যু ইঞ্জিনিয়ারিং, নিউজিল্যান্ড কন্ট্রোলড রিলিজ সোসাইটি, ক্যান্টাবুরি মেডিক্যাল রিসার্চ সোসাইটি, অস্ট্রেলিয়ান পলিমার সোসাইটি, আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির সদস্য তিনি। দিনাজপুর থেকে নিউজিল্যান্ড আজম আলীর জন্ম ১৯৬৭ সালের এপ্রিলে দিনাজপুরের সেতাবগঞ্জের বন্ধুগাঁয়ে। বাবা আবদুল জলিল চৌধুরী পেশায় ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। স্কুলে শিক্ষকতাও করেছেন তিনি। মা শরিফা বেগম গৃহিণী। বন্ধুগাঁয়ের আলো-বাতাসেই বড় হয়েছেন আজম আলী। একমাত্র আজম আলী ছাড়া সাত ভাই ও দুই বোনের সবাই এখন দিনাজপুরে আছেন। তিন ভাই সরকারি কর্মকর্তা, দুই ভাই শিক্ষক, এক ভাই ব্যবসায়ী আরেক ভাই কৃষিজীবী। সেতাবগঞ্জ পাইলট হাই স্কুল থেকে ১৯৮২ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে প্রথম বিভাগ নিয়ে মাধ্যমিক পাস করেছেন আজম আলী। পরে দিনাজপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজ থেকে ১৯৮৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। উচ্চ মাধ্যমিকেও প্রিয় বিজ্ঞান শাখা থেকে প্রথম বিভাগ পান। এরপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন রসায়নে। এখান থেকেই ১৯৮৯ সালে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৯১ সালে স্নাতকোত্তর পাস করেন প্রথম বিভাগ নিয়ে। মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি সেইনস মালয়েশিয়া থেকে পলিমার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ন্যানোটেকনোলজি বিষয় নিয়ে পিএইচডি করেন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন ১৯৯৭ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত। বর্তমানে আজম আলী পরিবার নিয়ে বাস করছেন নিউজিল্যান্ডে। আছেন ১০ বছর ধরে। এর আগে পেশাগত কারণে ছিলেন মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া ও যুত্তরাষ্ট্রে। স্ত্রী নার্গিস আজম। বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী। নার্গিস আজম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে স্নাতকোত্তর করেছেন। যুক্ত ছিলেন ইউনিসেফের সঙ্গে। এখন কাজ করছেন নিউজিল্যান্ডে কমিউনিটি সার্ভিস নিয়ে। তাঁদের দুই ছেলে। তাঁরাও বাবার পেশায় আসেননি। বড় ছেলে নাফিস আজম নিউজিল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব ক্যান্টাবুরির ছাত্র। আইন ও অর্থনীতি বিষয়ে আলাদাভাবে ডাবল ডিগ্রি করছেন। তাঁর আরেকটি পরিচয়, তিনি নিউজিল্যান্ডে ইউনিসেফের পক্ষ থেকে তরুণ সমাজের অ্যাম্বাসাডর। ছোট ছেলে আসিফ আজম ইন্টারমিডিয়েট লেভেলের স্কুলছাত্র। তার সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন।

Blog Archive