ব্যাপারটি কেবল স্বৈরাচারী সরকারের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়, বরং পৃথিবীতে এই মুহূর্তে অনেক গণতান্ত্রিক কিংবা নিয়ন্ত্রিত গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সরকারব্যবস্থার দেশেই ইন্টারনেটের ওপর খবরদারি ও নজরদারি চলে আসছে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে কেউই কিন্তু ইন্টারনেট কিংবা সামাজিক অনলাইন মাধ্যমের ওপর নিজেদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। বরং দিনে দিনে এই নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারটি সরকারগুলোর নিয়ন্ত্রণের বাইরেই চলে যাচ্ছে। ইন্টারনেট-ব্যবস্থার ওপর খবরদারি ও নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বেশি বদনাম কুড়িয়েছে চীন। সেখানে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ওয়েবসাইট কিংবা ব্লগের ওপর নজরদারি বজায় রাখতে চায় সে দেশের সরকার। পান থেকে চুন খসলেই বিভিন্ন ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেওয়া হয়। চীনের কমিউনিস্ট শাসনে অতিষ্ঠ হয়ে কেউ যদি কোনো সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে, তাহলেই সর্বনাশ। বিভিন্নভাবে সেই ব্যক্তি বা গোষ্ঠী হয়রানির শিকার হন। কিন্তু তার পরও চীনে সামাজিক মাধ্যম কিংবা ব্লগগুলোয় মন্তব্য প্রদানকারী কিংবা আলোচনাকারীদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সম্প্রতি পৃথিবীর অনেক দেশেই সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট নিয়ে রীতিমতো ‘বিপ্লব’ ঘটে গেছে। ব্যাপারটির শুরু সেই ২০০৯ সালে। ইরানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পরবর্তী সময়ে উদারপন্থী বিরোধী নেতা মৌসাভির নেতৃত্বে যে রক্তক্ষয়ী আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তার শুরুটা কিন্তু হয়েছিল ফেসবুক ও টুইটারের মতো জনপ্রিয় দুটি সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটে। পরে ইরান সরকার সে দেশে এই দুটি ওয়েবসাইট বন্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ কিন্তু প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। প্রযুক্তির চরম উত্কর্ষের যুগে একটি বা দুটি ওয়েবসাইট বন্ধ করে দিলেই যে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা যায় না, তা বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিল ইরান সরকার। এ বছর মিসর, তিউনিসিয়া প্রভৃতি দেশগুলোয় সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটের মাধ্যমেই সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদার হয়েছিল। এর ফলে ক্ষমতার মসনদ থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল হোসনি মোবারক ও বেন আলীর মতো দুজন কুখ্যাত একনায়ককে। ভারতে সমাজসংস্কারবাদী আন্না হাজারের অনশনকে জনপ্রিয় করেছে এই ইন্টারনেটই। এই সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটে সচেতন হয়েই রাজনীতির ব্যাপারে চরম অনাগ্রহী করপোরেট হাউসের একজন নির্বাহীও অফিস শেষে আন্নার অনশন জমায়েতে যোগ দিতে আগ্রহ দেখিয়েছে। পুরো ব্যাপারটিরই কৃতিত্ব সেই ইন্টারনেটেরই। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, আন্না হাজারের অনশনের প্রচারণায় বিরক্ত হয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের ভারত সরকারও ইন্টারনেটের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারাও ব্যর্থ। ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারটি যত দিন যাচ্ছে, সরকারগুলোর জন্য কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এক তো সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ব্যস্ততা, তার ওপর যোগ হয়েছে সাধারণ মানুষের তথ্য প্রযুক্তিগত জ্ঞান। কম্পিউটার ও সফটওয়্যার কিংবা ইন্টারনেট সম্পর্কে এখনকার প্রজন্ম এত বেশি জানে যে একটি ওয়েবসাইট বন্ধ করে দিলে, সেটিতে প্রবেশের অনেক বিকল্প পথ এখন অনেকেরই জানা। এ ব্যাপারে ভারতের সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ বিজয় মুখী বলেন, ইন্টারনেট এখন এত বিপুলভাবে বিস্তৃত যে সরকারের কাছ থেকে এর নিয়ন্ত্রণ খুব দ্রুতই বেরিয়ে যাচ্ছে। মানুষ এখন বন্ধ করে দেওয়া ওয়েবসাইটও বিকল্প পদ্ধতি ব্যবহার করে ব্যবহার করতে পারে। সরকারের সীমিত নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা আসলেই ‘ব্যর্থ প্রকল্পে’ পরিণত হয়েছে। এশিয়া ডিভিশন অব হিউম্যান রাইট ওয়াচের সহকারী পরিচালক ফিল রবার্টসনের মতে, ইন্টারনেটের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ খুবই সীমিত ও স্বল্পমেয়াদি একটি পদ্ধতি। দীর্ঘমেয়াদে এর কার্যকারিতা খুবই সীমিত। সরকার যদি একটি সংবাদভিত্তিক পোর্টালকে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি ঘোষণা করে বন্ধ করে দেয়, তাহলে কিছুদিন হয়তো মানুষ সেই সংবাদ পোর্টালে প্রবেশ করতে পারে না। কিন্তু একই ধরনের সংবাদ পোর্টালের বিশ্বময় সত্যিই কিন্তু অভাব নেই। মানুষ একটি বিকল্প ঠিকই তৈরি করে নেয়। তবে সব জিনিসেরই একটি খারাপ দিক আছে—এই চিরসত্যকে ধর্তব্যের মধ্যে নিয়ে ইন্টারনেটেরও ফাঁকফোঁকর খুঁজে বের করা যায়। ইন্টারনেট কিংবা সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটকে দুষ্ট লোকেরা যদি বাজেভাবে ব্যবহার করে, তার পরিণতি কী হতে পারে, এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ সাম্প্রতিক কালে ব্রিটেনে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ দাঙ্গা ও লুটতরাজ। ইন্টারনেটে সংগঠিত হয়ে দাঙ্গাবাজেরা যা কাণ্ড-কীর্তি সেখানে করেছে, তাতে ব্রিটেনের মতো স্বাধীন ও অবাধ মতপ্রকাশের দেশ ব্রিটেনের সরকারও ইন্টারনেট ব্যবস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপে বাধ্য হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা পর্নোগ্রাফির ভয়াবহতার কথা না হয়, না-ই বলা হলো। সব মিলিয়ে ইন্টারনেট যেহেতু যুগের চাহিদা, সেখানে এর ওপর অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ আরোপের বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়েছেন মানবাধিকার সংগঠনগুলো। কোনো ব্যক্তি যদি তাঁর মোবাইল ফোনে যেকোনো ব্যক্তির সঙ্গে যা ইচ্ছা তাই বলতে পারেন, তাহলে ইন্টারনেটের ওপর নিষেধাজ্ঞা বা নিয়ন্ত্রণ কেন? তথ্যের যে অবাধ প্রবাহ এই ইন্টারনেট সৃষ্টি করেছে, তার স্বাভাবিক গতি বাধাগ্রস্ত হলে তার প্রভাব পুরো দেশের ওপরই পড়তে বাধ্য—এমন কথাই বারবার বলছেন বিশেষজ্ঞরা। রয়টার্স।