গেরুয়া পরে তন্ত্রবলে ব্যক্তিগত সমস্যা সমাধানের আড়ালে খাস কলকাতায় মধুচক্র ও নীল ছবির রমরমা ব্যবসা চালান তিনি। একই সঙ্গে চলে তন্ত্রমন্ত্র, বশীকরণ, তুকতাক৷ আন্তঃরাজ্য নীল ছবির এই বিশাল চক্রের মূল এক নকল বাবাজি৷ সন্ন্যাসীর ভেক ধরে তরুণী গৃহবধূদের নিজের শাগরেদের ফ্ল্যাটে ডেকে নিয়ে একাধিকবার গণধর্ষণ করে সেই দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করে রাখাই ছিল সাধুবাবা ও তার সঙ্গীদের মূল কারবার৷ পারিবারিক অশান্তির জন্য বেহালার পর্ণশ্রীর ওই 'সাধুবাবার' শরণাপন্ন হয়েছিলেন এক গৃহবধূ৷ 'সাধুবাবা' তাঁকে উপর্যুপরি ধর্ষণ করেছেন বলে অভিযোগ৷ পুলিশ সাধু-সহ চার জনকে গ্রেপ্তার করেছে৷ এই চক্রে মহিলাদের ভূমিকাও কম নয়৷ গৃহবধূর অভিযোগ, তাঁকে ধর্ষণ করার ছবি মোবাইলে তুলে রেখেছিলেন সাধু-চক্রের মহিলা সদস্যরা৷ প্রথমবার ধর্ষণের সময়ে সব ছবি তুলে রাখা হয়েছিল৷ পরে সেই ছবি দেখিয়ে ব্ল্যাকমেল করে চলেছে আরও দু'বার ধর্ষণ৷ ধৃতদের মধ্যে এক মহিলা রয়েছেন৷ অন্য মহিলার অবশ্য কোনও সন্ধান নেই৷ বুধবার ধৃতদের আলিপুর আদালতে তোলা হলে বিচারক ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত পুলিশ হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছেন৷
'সাধু'র নাম দীপ চক্রবর্তী৷ বেহালা বা মহেশতলা চত্বরে তাঁর যথেষ্ট পরিচিতি৷ অভিযোগ, দীপ চক্রবর্তী একা নন, তাঁর সঙ্গে ধর্ষণ করেছিলেন আরও দু'জন৷ বেহালার পর্ণশ্রী থানার অভয় বিদ্যালঙ্কার রোডের বাড়িটিতে স্ত্রীকে নিয়ে ভাড়া থাকেন অন্যতম অভিযুক্ত শান্তনু নাথ৷ বাড়ির মালিক অন্যত্র থাকেন৷ সেই সুযোগে প্রতি রাতে বাড়িতে মধুচক্র বসত বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা৷ এই বাড়িতেই তোলা হয়েছিল আঠারো ছুঁই ছুঁই অভিযোকারিণীকে৷ মহেশতলার বাসিন্দা তরুণীটিকে বাবার কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর দুই পরিচিত আশিস দেব ও তাঁর স্ত্রী৷ ধর্ষিতা গৃহবধূ মঙ্গলবার পর্ণশ্রী থানায় দায়ের করা অভিযোগে বলেছেন, সব সমস্যা মিটিয়ে দেওয়ার কথা বলে ২৯ অগস্ট ওই সাধু, আশিস দেব ও তাঁর স্ত্রী তাঁকে পর্ণশ্রীতে নিয়ে যান৷ সেখানেই শান্তনু, আশিস ও দীপ তাঁকে ধর্ষণ করে৷ সেই ছবি মোবাইলে তুলে রাখার অভিযোগ উঠেছে শান্তনুর স্ত্রী মৌসুমি ও আশিসের স্ত্রীর বিরুদ্ধে৷ যদিও আশিসের স্ত্রীর ভূমিকা নিয়ে সংশয়ী পুলিশই৷ বেহালার ডিসি সুব্রত মৈত্র বলেছেন, মোবাইলে ছবি তোলার অভিযোগে আরও এক মহিলাকে খোঁজা হচ্ছে৷ তবে তদন্ত না-করে তাঁর ভূমিকা কী ছিল, বলা যাবে না৷ ধর্ষিতার গোপন জবানবন্দি আদালতে রেকর্ড করানো হয়েছে৷
ধর্ষণের কথা কাউকে জানালে মোবাইলে তোলা ছবি এমএমএস হয়ে ছড়িয়ে পড়বে, এই হুমকি চলছিল ক্রমাগত৷ সেই হুমকি দিয়েই অক্টোবরের ৪ ও ৬ তারিখ তরুণীকে আনা হয় ওই বাড়িতে৷ অভিযোগ, তিন পুরুষ মিলে ফের চালায় নারকীয় অত্যাচার৷ প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের ধারণা, অভিযোগকারিণীকে মাদক জাতীয় কিছু খাইয়ে চলেছে ধর্ষণের পালা৷ পর্ণশ্রীর অভয় বিদ্যালঙ্কার রোডে বছর তিনেক আগে ভাড়া আসেন শান্তনু৷ দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে দোতলা বাড়ির উপরের তলায় থাকতেন৷ স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, বাড়িওয়ালা বেহালায় অন্য একটি বাড়িতে থাকেন৷ নীচতলায় আরও এক ভাড়াটে থাকতেন৷ কিন্ত্ত শান্তনুর উত্পাতে তাঁরা বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হন বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী৷ শান্তনু নিজেকে ম্যানেজমেন্ট সংস্থার কর্তাব্যক্তি বলে পরিচয় দিয়েছিলেন৷ অথচ, দিনের আলোয় তাঁকে বাড়ি থেকে সে ভাবে বেরোতে দেখা যায়নি কোনও দিন৷ এমনকি গোটা বাড়িও নিঝুম থাকত৷ কিন্ত্ত রাত বাড়তেই জেগে উঠত সেই বাড়ি৷ রাতভর নারী-পুরুষ কণ্ঠের উল্লাস ভেসে আসত৷ অপরিচিত মহিলা ও পুরুষদের ছিল সে বাড়িতে অবাধ যাতায়াত৷
অতিষ্ঠ হয়ে পাড়ার লোক প্রতিবাদ করেছেন৷ কিন্ত্ত তাতে অশান্তি ছাড়া আর কিছু হয়নি৷ প্রতিবেশীদের সন্দেহ, কোনও বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার সঙ্গে শান্তনুর যোগাযোগ ছিল৷ কেননা, দিন কয়েক আগে বেশ কিছু লোককে টাকা আদায়ের জন্য ওই বাড়িতে হানা দিতে দেখেছেন তাঁরা৷ কাবুলিওয়ালাদেরও আসতে দেখা যেত ওই বাড়িতে৷ প্রতিবেশীরা বলছেন, এই এলাকা বেহালা থানার অধীনে থাকাকালীন একবার পুলিশও এসেছিল৷ কিন্ত্ত কোনও অজ্ঞাত কারণে স্রেফ কথাবার্তা বলেই সে সময়ে পুলিশ চলে যায়৷ তার পর থেকে কেউ আর তেমন ঘাটাননি পরিবারটিকে৷ প্রতিবেশীদের অভিযোগ, পুলিশ ও প্রশাসনের একাংশকে হাত করে এই বাড়িতে মধুচক্র চালানো হত৷
নির্যাতিতার অভিযোগ পাওয়ার পরে পুলিশ মঙ্গলবার রাতেই গ্রেপ্তার করে দীপ চক্রবর্তীকে৷ তাঁকে নিয়ে রাতে তল্লাশি চালিয়ে অভয় বিদ্যালঙ্কার রোডের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয় সস্ত্রীক শান্তনুকে৷ এর পর আশিসকে পাকড়াও করা হলেও, তাঁর স্ত্রীর কোনও সন্ধান নেই৷ এ দিন আদালত চত্বরে ভিড় জমে যায় অভিযুক্ত সাধুকে দেখতে৷ ছবিতে এবং টিভি-র পর্দায় দেখা এক পরিচিত সাধুর সঙ্গে চেহারা ও হাবভাবে বেশ মিল রয়েছে দীপ চক্রবর্তীর৷ তাঁর ছবি মোবাইলে তুলে রাখতে একসময়ে হুড়োহুড়ি পড়ে যায় থানা এবং আদালত চত্বরে৷ কোনওক্রমে উত্সাহী জনতাকে সামাল দেয় পুলিশ৷