মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতে প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখতে পারছে না শেয়ারবাজার। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১১ সালে আইপিও (ইনিশিয়াল পাবলিক অফারিং) থেকে সংগৃহীত অর্থের পরিমাণ ছিল জিডিপির ০.১৭ শতাংশ। যেখানে ব্যাংক অর্থায়নের ভূমিকা ছিল ৪৩.৯৯ শতাংশ।
গতকাল শনিবার বিআইবিএম আয়োজিত 'ব্যাংক, শেয়ারবাজার ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি : প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ' শীর্ষক এক জাতীয় সেমিনারে গবেষণালব্ধ এ তথ্য তুলে ধরা হয়। সেমিনারে গবেষণার ওপর তৈরি করা একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ও বিআইবিএমের অধ্যাপক হাবিবুল্লাহ বাহার। প্রবন্ধের বিভিন্ন বিষয়ের ব্যাখ্যা করেন প্রতিষ্ঠানটির অধ্যাপক ও পরিচালক (আরডি অ্যান্ড সি) ড. প্রশান্ত কুমার ব্যানার্জি।
গবেষণা পদ্ধতি সম্পর্কে ড. ব্যানার্জি বলেন, এতে তিনটি বিষয় আলোচনা করা হয়েছে। ব্যাংকের সঙ্গে প্রবৃদ্ধির সম্পর্ক, শেয়ারবাজারের সঙ্গে প্রবৃদ্ধির সম্পর্ক এবং ব্যাংক ও শেয়ারবাজারের সঙ্গে প্রবৃদ্ধির সম্পর্ক ব্যাখ্যা করা হয়েছে। দেখা গেছে, ব্যাংক অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। অন্যদিকে শেয়ারবাজার প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখতে সফল হচ্ছে না। তবে ব্যাংক ও শেয়ারবাজার একসঙ্গে মোটামুটি একটি ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
এ বিষয়ের ওপর আলোচনা করতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ব্যাংক ও শেয়ারবাজার দুটোই অভিঘাত (শক) বহন করে। ব্যাংক খাতের অভিঘাত প্রশমনে এর নিয়ন্ত্রক সংস্থা যতটা ভূমিকা রাখতে পেরেছে, শেয়ারবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ততটা পারেনি। শেয়ারবাজার কারসাজির তদন্তকাজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ইব্রাহিম খালেদ বলেন, এসইসি সত্যিকার অর্থে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকাতেই ছিল না। ছিল কলাবোরেটরের ভূমিকায়। সে সময় এর কর্মকর্তারা কারসাজি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা না করে বরং সহযোগিতা করেছিলেন। তিনি আরো বলেন, 'শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ সীমিত করা হয়েছে। কিন্তু একটা সময় পর্যন্ত শেয়ারবাজারে আমানতের ১০ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগের সুযোগ ছিল। কোনো কোনো ব্যাংক এই ১০ শতাংশও অতিক্রম করে গিয়েছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেক পরে এ বিষয়ে সজাগ হয়।' এ সময় তিনি বাছবিচার ছাড়াই অমনিবাস অ্যাকাউন্ট খোলার বিধান রাখার সমালোচনা করেন।
প্রাইম ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ ইয়াসিন আলী বলেন, আইপিও ইস্যুর খরচ বেশি হওয়ায় অনেক কম্পানি শেয়ারবাজারে আসতে চায় না। এ ক্ষেত্রে আইপিও ইস্যুর খরচ কমানো গেলে অনেক কম্পানি শেয়ারবাজারে আসত। এতে কম্পানির স্বচ্ছতা বাড়বে। সরকারও বেশি রাজস্ব পাবে। বিনিয়োগকারীরা লাভবান হবেন।
সেমিনারে উপস্থাপিত গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়েছে, ২০০৭ সালে জিডিপি অর্থায়নে ব্যাংকের ভূমিকা ছিল ৩৩.৮৬ শতাংশ। ২০০৮ সালে তা বেড়ে ৩৫.৯৮ শতাংশ হয়। ২০০৯ ও ২০১০ সালে তা বেড়ে হয় যথাক্রমে ৩৭.৯৮ ও ৪২.৬১ শতাংশ। অন্যদিকে ২০০৭ সালে আইপিও থেকে সংগৃহীত অর্থ ছিল জিডিপির ০.৪৭ শতাংশ। ২০০৮ সালে তা কমে ০.০৬৭ শতাংশ হয়। ২০০৯ ও ২০১০ সালে ছিল যথাক্রমে ০.২১ ও ০.৪২ শতাংশ।
উপস্থাপিত তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সালে চীন, মালয়েশিয়া ও ভারতের জিডিপি অর্থায়নে ব্যাংকের ভূমিকা ছিল যথাক্রমে ১৪৫.৫ শতাংশ, ১২৮.৭ শতাংশ ও ৭৪.১ শতাংশ। যেখানে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের ভূমিকা ছিল ৪৩.৯৯ শতাংশ।
২০১১ সালে চীন, মালয়েশিয়া ও ভারতে আইপিও থেকে সংগৃহীত অর্থ দেশগুলোর জিডিপির যথাক্রমে ১.১৫ শতাংশ, ১.৭২ শতাংশ ও ০.৩৫ শতাংশ। যেখানে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের ভূমিকা ছিল মাত্র ০.১৭ শতাংশ।
আলোচকদের অভিমত, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাংক ও শেয়ারবাজারের পরিপূরকভাবে গুরুত্ব রাখতে হবে। এ লক্ষ্যে নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে কাজ হওয়া প্রয়োজন। এ কাজে গবেষণাটি সহযোগিতা করবে বলে আশা করেন সেমিনারের আয়োজকরা। বিআইবিএমের মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে সেমিনারে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন জনতা ক্যাপিটাল অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী মো. জাহাঙ্গীর মিয়া ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহমুদ ওসমান ইমাম।
অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও অতালিকাভুক্ত কম্পানিগুলোর জন্য একটি সিকিউরিটিজ মার্কেট করার প্রস্তাব দেন মো. জাহাঙ্গীর মিয়া। এ ছাড়া তৃতীয় মার্কেটের নামে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য একটি বাজার চালুরও প্রস্তাব করেন তিনি।
ড. ওসমান ইমাম বলেন, এ গবেষণাটি মূলত জিডিপি অর্থায়নের ওপর করা হয়েছে, প্রবৃদ্ধির ওপর নয়। প্রবৃদ্ধি ধরে গবেষণা করলে কার্যকর একটি গবেষণা হতো।