শেয়ারবাজার :::: সরকার উন্মুক্ত নিলামের মাধ্যমে তৃতীয় প্রজন্ম (থ্রি-জি) লাইসেন্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একই সঙ্গে মুঠোফোন অপারেটরদের দ্বিতীয়
প্রজন্ম (টু-জি) লাইসেন্স নবায়ন-নীতিমালা ঠিক করা হয়েছে।
থ্রি-জি চালু হলে উচ্চগতির কারণে মুঠোফোনে কথা বলার পাশাপাশি যার সঙ্গে কথা বলা হচ্ছে, তাকে দেখাও যাবে। এ ছাড়া মুঠোফোনে টিভি দেখা, ভিডিও কনফারেন্সসহ উচ্চগতির ইন্টারনেট ব্যবহার করা সম্ভব হবে। থ্রি-জির জন্য মুঠোফোন কোম্পানিগুলোকে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করতে হবে।
নতুন নীতিমালায় তরঙ্গ ও আনুষঙ্গিক ফি চূড়ান্ত করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাতিল করা হয়েছে বহুল আলোচিত তরঙ্গের ব্যবহারভিত্তিক ফি। মুঠোফোন কোম্পানিগুলো এই ফি বাতিল করার দাবি জানিয়ে আসছিল।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উচ্চপর্যায়ের এক বৈঠকে গতকাল মঙ্গলবার এ সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকে দ্বিতীয় প্রজন্মের (টু-জি) লাইসেন্স নবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় তরঙ্গ ও আনুষঙ্গিক ফি চূড়ান্ত করা হয়। এসব ফি ঠিক হওয়ায় আগামী ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যেই নবায়ন-নীতিমালাটি চূড়ান্ত করা হবে।
উল্লেখ্য, আগামী ১০ নভেম্বর গ্রামীণফোন, রবি, বাংলালিংক ও সিটিসেলের লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। এ সময়ের মধ্যে এই চারটি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স নবায়ন করতে হবে।
প্রায় আট মাস ধরে টেলিযোগাযোগ খাতে ব্যাপক আলোচনা চলছিল এ বিষয়গুলো নিয়ে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি), ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে এ নিয়ে একাধিক বৈঠক ও ফাইল চালাচালি হয়। অবশেষে প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বিষয়টি চূড়ান্ত হলো। এর ফলে মুঠোফোন খাতে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অনিশ্চয়তা কাটবে বলে সরকার আশা করছে।
গতকালের সভা শেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ সাংবাদিকদের জানান, বৈঠকে থ্রি-জি লাইসেন্স আগামী ছয় মাসের মধ্যে চালু এবং পরীক্ষামূলকভাবে টেলিটককে এ সেবা চালুর অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। চূড়ান্ত পর্যায়ে এ সেবা চালুর জন্য উন্মুক্ত নিলামের মাধ্যমে আরও কয়েকটি অপারেটরকে লাইসেন্স দেওয়ার বিষয়টিও বৈঠকে নির্ধারণ করা হয়েছে। নিলামে দেশের বর্তমান মুঠোফোন অপারেটর ছাড়াও অন্য যেকোনো আগ্রহী ব্যক্তি বা দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে পারবে।
ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজি উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘টু-জি লাইসেন্স নবায়নের সব ধরনের ফি বৈঠকে চূড়ান্ত করা হয়েছে। এর আগে এ বিষয়ে অপারেটরদের সঙ্গে আলোচনা করে নেওয়া হয়েছে। এতে কোনো অপারেটরের আপত্তি থাকার কথা নয়।’
মন্ত্রী আরও জানান, ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে টু-জি লাইসেন্স নবায়ন নীতিমালা চূড়ান্ত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী তাগাদা দিয়েছেন। নীতিমালা চূড়ান্ত হওয়ার পরই লাইসেন্স নবায়নের জন্য আবেদন চেয়ে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হবে।
সচিবালয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব সুনীল কান্তি বোস গতকাল সংক্ষিপ্ত এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, মুঠোফোন অপারেটরদের রাজস্ব ভাগাভাগি ৫ দশমিক ৫ শতাংশ করার বিষয়টিও চূড়ান্ত করা হয়েছে। তরঙ্গের মেগাহার্টজ-প্রতি ফি ১৮০০ ও ৯০০ উভয় ব্যান্ডের জন্য একই অর্থাৎ ১৫০ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এদিকে, গতকাল সিডিএমএ প্রযুক্তির ৮০০ মেগাহার্টজের দাম নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বৈঠক শেষে টেলিযোগাযোগসচিব সাংবাদিকদের বলেছেন, এই মেগাহার্টজের দাম ৮০ কোটি টাকা। পরে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে সন্ধ্যা সাতটায় মুঠোফোনে সংশোধনী দিয়ে বলা হয়, এর দাম ১০০ কোটি টাকা। বিটিআরসির চেয়ারম্যান জিয়া আহমেদ জানান, ৮০০ মেগাহার্টজের দাম ১৫০ কোটি টাকাই বহাল রয়েছে।
দুপুরের সংবাদ সম্মেলনে সচিব আরও জানান, টু-জি লাইসেন্স নবায়নে সোশ্যাল অবলিগেশন ফির ক্ষেত্রে বিটিআরসি প্রস্তাব করেছিল ১ দশমিক ৫ শতাংশ। এটি কমিয়ে এখন ১ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় এটি শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছিল।
মুঠোফোন অপারেটররা টু-জি লাইসেন্স নবায়নের সব ধরনের ফি চার কিস্তিতে পরিশোধ করতে পারবে বলে সচিব জানান। তবে মোট টাকার ৪৯ শতাংশ শোধ করতে হবে চলতি বছরের নভেম্বরের মধ্যেই। বাকি ৫১ শতাংশ তিন কিস্তিতে ভাগ করে আগামী বছর থেকে পরিশোধ করতে হবে।
এ বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিফোন অপারেটরস ইন বাংলাদেশের (অ্যামটব) মহাসচিব আবু সাঈদ খান প্রথম আলোকে বলেন, থ্রি-জি স্পেকট্রাম নিলামের মাধ্যমে বরাদ্দ দেওয়ার সিদ্ধান্তই প্রত্যাশিত ছিল। তরঙ্গ বরাদ্দের বিষয়টি নিরপেক্ষভাবে চূড়ান্ত করা হবে বলে আশা করা যায়। তবে টেলিটককে নিলামের আগেই থ্রি-জি সেবা চালুর সুযোগ দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি মন্তব্য করেন, ভারতীয় টেলিযোগাযোগশিল্প থেকে বাংলাদেশ সরকার এই খারাপ ধারণা ও উদাহরণ গ্রহণ করেছে। তিনি বলেন, সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান টেলিটক এমনিতেই টু-জি ব্যবসায় প্রচুর লোকসান দিয়েছে। এই অবস্থায় ওই প্রতিষ্ঠানের ওপর থ্রি-জি প্রযুক্তি প্রশাসনিকভাবে আরোপ করা কোনোমতেই যৌক্তিক নয়। কোনো ধরনের প্রযুক্তির ব্যবসায়িক সার্থকতা বা ব্যর্থতা প্রশাসনিক নির্দেশ নিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।
বৈঠকে টু-জি লাইসেন্স নবায়নের ক্ষেত্রে তরঙ্গের ব্যবহারভিত্তিক ফি বা ইউটিলাইজেশন ফ্যাক্টর (ইউটিএফ) বাতিল করা হয়েছে। ২০০৬ সাল থেকে তরঙ্গ বরাদ্দের ওপর গ্রাহকসংখ্যার ভিত্তিতে বার্ষিক ফি নেওয়া হতো। পরে গ্রাহকসংখ্যা বাদ দিয়ে প্রতি মেগাহার্টজের জন্য বর্গকিলোমিটারপ্রতি এক মার্কিন ডলার করে ‘স্পেকট্রাম ট্যারিফ’ ইউনিট ধার্য করা হয়। এর বদলে তরঙ্গ ব্যবহারের ওপর ভিত্তি করে নতুন ফি নির্ধারণের কথা বলা হয়েছিল খসড়া নীতিমালায়। ইউটিএফ কার্যকর হলে সর্বোচ্চ গ্রাহকের প্রতিষ্ঠানকে সবচেয়ে বেশি এবং বাকিদের আনুপাতিক হারে অর্থ দিতে হতো।
দেশে বর্তমানে পাঁচটি গ্লোবাল সিস্টেম ফর মোবাইল (জিএসএম) ও একটি কোড ডিভিশন মাল্টিপল এক্সেস (সিডিএমএ) প্রযুক্তিসম্পন্ন অপারেটররা সেবা দিচ্ছে। বিটিআরসির তথ্য অনুযায়ী সাড়ে সাত কোটির বেশি মুঠোফোন ব্যবহারকারী রয়েছেন। আর এক কোটির বেশি গ্রাহক ইন্টারনেট সেবা নিচ্ছেন। এর ৯৪ শতাংশই মুঠোফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গতকাল অনুষ্ঠিত টানা সোয়া দুই ঘণ্টার বৈঠকে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজি উদ্দিন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভী, মসিউর রহমান, বিজ্ঞান, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান, অর্থসচিব মোহাম্মদ তারেক, বিটিআরসির চেয়ারম্যান জিয়া আহমেদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।