প্রাথমিক বাজারে শেয়ারের গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মূল্য নির্ধারণের মধ্যেই বড় ধরনের ধসের প্রথম সূত্র নিহিত ছিল। ২০০৯ ও ২০১০ সালে বাজারে আসা অধিকাংশ আইপিওই ছিল অতিমূল্যায়িত। তা যেমন ছিল এসইসি থেকে প্রিমিয়ামসহ আইপিও ছাড় করার ক্ষেত্রে, তেমনই বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতেও। পাশাপাশি গত কয়েক বছরে শেয়ারের সরবরাহের বিষয়টি যত না গুরুত্ব পেয়েছে, তার চেয়ে ঢের বেশি চাহিদা তৈরি করা হয়েছে সেকেন্ডারি বাজারকে চাঙা করে তুলতে। আর এর ফায়দা তুলতে প্রাথমিক শেয়ারকে অতিমূল্যায়ন করে কিছু কোম্পানিকে অতিরিক্ত অর্থ পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থাও হয়েছে।
কয়েক বছর ধরে এগুলো ক্ষেত্রবিশেষে জেনে-বুঝেও নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) অনুমোদন দিয়ে গেছে। এমনকি নজিরবিহীন উদ্ভাবনীর ফাঁদ তৈরি করে আইপিওতেই বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। চাঙা সেকেন্ডারি বাজারে প্রাথমিক বাজারের এই অতিমূল্যায়নের প্রভাবে নতুন বুদ্বুদ তৈরি হয়েছে। এসইসি ক্ষেত্রবিশেষে নীতি-সহায়তা তৈরি করেও তাকে উৎসাহ জুগিয়েছে।
এর ফলে শেয়ারবাজারে যে বড় বিপর্যয় আসবে, এ আশঙ্কা দেশি-বিদেশি সংস্থা ও বিশেষজ্ঞ অনেকেই সরকার ও এসইসিকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু বাজারে নতুন কারসাজির সিদ্ধান্তই আসতে দেখা গেছে বারবার।
স্টক এক্সচেঞ্জে কোম্পানির সরাসরি তালিকাভুক্তির (ডাইরেক্ট লিস্টিং) ক্ষেত্রে এসইসি নজিরবিহীন ছাড়ের দৃষ্টান্ত তৈরি করে। সরাসরি তালিকাভুক্তিতেও প্লেসমেন্ট শেয়ারের সুযোগ দেওয়া এবং এই শেয়ারগুলোর হাত বদলে কোনো বাধানিষেধ ছিল না। অর্থাৎ একটি কোম্পানি ডিএসইতে সরাসরি তালিকাভুক্ত হলে এই কোম্পানির শেয়ারের বাজারদর শুরুতে কী হবে, সেটা নির্ধারণ করার দায়িত্ব যাদের দেওয়া হয়েছে, তাদেরও কোম্পানি আগাম শেয়ার বরাদ্দ দিয়ে রেখেছে। এ ছাড়া কোম্পানির শেয়ারের প্লেসমেন্ট বিক্রি করতে ডিএসইর ব্রোকার ও মার্চেন্ট ব্যাংককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এই ব্রোকার বা মার্চেন্ট ব্যাংক বিভিন্ন বিনিয়োগকারীর কাছে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি প্রিমিয়াম নিয়ে তা বিক্রি করেছে। এদেরই কোনো কোনো বিনিয়োগকারী আরেক বিনিয়োগকারীর কাছে আরও উচ্চ মূল্যে শেয়ার বেচার একধরনের অলিখিত চুক্তি করে টাকা নিয়ে গেছে। এসবের মাধ্যমে কোনো বিনিয়োগ ছাড়াই ফরোয়ার্ড সেলের মাধ্যমে বড় অঙ্কের মুনাফা তুলে নিয়েছে অনেকেই। প্রাথমিক শেয়ারের দর নির্ধারণে হিসাবে কারসাজি (অ্যাকাউন্টিং জাগলিং) যেমন ছিল, তার চেয়ে ভয়াবহ ছিল এই প্রাথমিক বাজারের প্লেসমেন্ট শেয়ারের অবৈধ ‘কার্ব’ ব্যবসা। এ কাজে ডিএসইর নেতৃত্বের অনেকেই যুক্ত ছিলেন। এমনকি সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে এসইসির কোনো কোনো কর্মকর্তা এতে জড়িত থাকার তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এতে বাজার নিয়ন্ত্রণের কাজটিই কেবল বাধাগ্রস্ত হয়নি, বরং নতুন বুদ্বুদ তৈরি করতে ক্ষেত্রবিশেষে সরকার, এসইসি ও সংসদীয় স্থায়ী কমিটি থেকে ম্যানিপুলেটিভ (মূল্য কারসাজি) সিদ্ধান্ত এসেছে বারবার।
একটি কোম্পানির উদাহরণ দেওয়া যাক। বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে এই কোম্পানির শেয়ারের নির্দেশক মূল্য ছিল ১৬২ টাকা। এটা ধরে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম প্রথম দিনে ৩৪১ টাকা উঠেছিল। আর বাজারে ধসের আগে গত ৯ ডিসেম্বর কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ছিল ১১৮ টাকা ৫০ পয়সা। এর মধ্যেই কোম্পানিটি ২০ শতাংশ হারে বোনাস শেয়ারও দিয়েছে।
বাইরে থেকে ভুয়া বিনিয়োগকারীদেরও ডেকে আনা হয়েছে। যেমন, কেম্যান আইল্যান্ডের বিনিয়োগ কোম্পানি জেম গ্লোবালকে (যার পরিশোধিত মূলধন মাত্র এক সেন্ট) শেয়ারে ঋণ দেওয়ার অভিনব চুক্তি হয়েছে একাধিক কোম্পানির সঙ্গে। অল্প কিছু অর্থ এনে জেম গ্লোবাল চাঙা বাজারে ঋণের শেয়ার নিয়ে তা বিক্রি করেছে। আবার বিক্রির টাকায় নতুন শেয়ার নিয়েছে জেম গ্লোবাল। পরে শেয়ার বিক্রির অর্থ নিয়ে গেছে বিদেশে। এ ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রাবিনিময় আইন ভঙ্গ করা হয়েছে।
গত দুই বছরে বহুসংখ্যক কোম্পানি সম্পদের পুনর্মূল্যায়ন করেছে। শেয়ারের মূল্য বাড়াতে কোম্পানিগুলো তাদের জায়গাজমি, দালান, যন্ত্রপাতির পুনর্মূল্যায়ন করিয়েছে। এগুলোও বাজারকে স্ফীত করতে ভূমিকা রেখেছে।
আবার শেয়ারবাজারকে উপজেলা পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ব্রোকারেজ হাউস খুলে। রোড শো করে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীকে বাজারে ঢোকাতে ডিএসই-সিএসইর দিক থেকে প্রাণান্তকর চেষ্টা ও প্রলোভন তৈরি করা হয়েছে। এভাবে শেয়ারের ব্যবসায় প্রলুব্ধ করা হয়েছে দেশের তুলনামূলক অন্ধকারে থাকা লাখ লাখ বিনিয়োগকারীকে। মানুষ জমি বিক্রি করে, ধার করে অর্থ নিয়ে বাজারে ঢুকেছেন। ঢালাওভাবে ব্রোকারেজ হাউস খোলার কাজটি যখন চলেছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থা কোন কারণে সেদিকে নজর দেয়নি, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সরকার গত বছর জুলাই মাসে সঞ্চয়পত্রের সুদ কমিয়েছে আর বাজেটে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর উৎসে কর বসিয়েছে ১০ শতাংশ হারে। ওয়েজ আর্নার্স বন্ডেও সুদ কমানো হয়েছে, আবার স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনর্বিনিয়োগ বন্ধ করা হয়েছে। স্বল্প আয়ের ও পেনশনভোগীদের একবারেই নির্ধারিত কিছু অর্থপ্রাপ্তিতে করারোপ হলো, অথচ শেয়ারবাজারে মূলধনি মুনাফার ওপর কোনো কর বসানো হয়নি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর বসানোর প্রস্তাব করলেও ডিএসইর প্রভাবে শেষ পর্যন্ত শুধু প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের মূলধনি মুনাফার ওপর ১০ শতাংশ করারোপ করা হয়। ডিএসইর তৎকালীন সভাপতি রকিবুর রহমান বিভিন্ন সময় গর্ব করতেন করারোপ করতে না দেওয়ায় তাঁর ভূমিকা নিয়ে। একইভাবে তিনি ২০০৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে এসইসির দুই কর্মকর্তাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেন, তফসিলি ব্যাংকগুলোকে পোর্টফোলিও-সংক্রান্ত মাসিক রিপোর্ট পাঠানোর যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, তা কার্যকর করা হবে না। কোনো তথ্য প্রয়োজন হলে এসইসির মাধ্যমে তা সংগ্রহ করা হবে। তিনি আরও বলেছিলেন, বিনিয়োগসীমা লঙ্ঘনের দায়ে কয়েকটি ব্যাংকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে মর্মে একটি সংবাদপত্রে যে খবর প্রকাশিত হয়েছে, তা-ও সঠিক নয়।
ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সেকেন্ডারি বাজারে প্রলুব্ধ করতে ভুলভাবেও সূচক গণনা করা হয়েছে ডিএসইতে। এতে বাজারের প্রকৃত পরিস্থিতির চেয়ে অনেক উচ্চ অবস্থার তথ্য দেওয়া হয় বিনিয়োগকারীদের কাছে। তাতে তেজি অবস্থায় ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা দ্রুত মুনাফা লাভের আশায় বাজারে ঢুকে পড়েন। ডিএসইতে যখন সাধারণ মূল্যসূচক চার হাজার ৫৩৫ পয়েন্ট ছিল, তখন আন্তর্জাতিক পদ্ধতি অনুসরণ করলে সূচক হতো তিন হাজার পয়েন্টের মতো।
গ্রামীণফোনের শেয়ার লেনদেন শুরুর দিন বাজারের প্রবৃদ্ধিকে বড় করে দেখানোর জন্য আন্তর্জাতিক সূত্র না মানা ছাড়াও প্রারম্ভিক মূল্য ৭০ (অভিহিত মূল্য-১০ টাকা ও প্রিমিয়ার-৬০ টাকা) টাকার পরিবর্তে ১০ টাকা ধরে সূচক হিসাব করা হয়। এতে বাজারে সূচক কয়েক শ পয়েন্ট বেশি বেড়ে যায়। এর বাইরেও সূচক গণনায় অনেক স্বেচ্ছাচারিতা করেছে ডিএসই। যেমন, সরাসরি তালিকাভুক্ত যমুনা অয়েল কোম্পানির শেয়ার লেনদেন শুরু হয় ২০০৮ সালের ৯ জানুয়ারি। কিন্তু এর তিন দিন পর ১৩ জানুয়ারি কোম্পানিটির লেনদেনের তথ্য সূচকে যুক্ত হয়। একই ঘটনা ঘটে সরাসরি তালিকাভুক্ত এসিআই ফর্মুলেশন ও শাইনপুকুর সিরামিকসের ক্ষেত্রে। এ দুই কোম্পানি সূচকে যুক্ত হয় চতুর্থ লেনদেন দিবসে। অথচ মেঘনা পেট্রোলিয়াম ও নাভানা সিএনজি লেনদেনের প্রথম দিনেই সূচকে যুক্ত হয়। আবার ডিএসই একপর্যায়ে এসইসির অনুমোদন ছাড়াই নতুন তালিকাভুক্তসহ মোট ২৪ কোম্পানির কেবল লেনদেনযোগ্য (ফ্রি ফ্লোট) শেয়ার নিয়ে সূচক গণনা শুরু করে। এ পর্যায়ে উদ্যোক্তাদের বা ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে প্লেসমেন্টের মাধ্যমে বরাদ্দ দেওয়া যেসব শেয়ার সাময়িকভাবে বিক্রি নিষিদ্ধ (লক ইন) থাকে, তা সূচক গণনায় নেওয়া হয়নি। পরিষ্কার ইঙ্গিত মেলে যে, ডিএসই কখনো সূচককে বেশি দেখিয়ে সেকেন্ডারি বাজারে বিনিয়োগকারীকে প্রলুব্ধ করেছে, আবার যখন সূচক অতিমূল্যায়িত হয়ে পড়েছে, তখন তা নীতিনির্ধারকদের কাছে আড়াল করতে সূচক কম দেখানোর কৌশল নিয়েছে।
কয়েক বছর ধরে এগুলো ক্ষেত্রবিশেষে জেনে-বুঝেও নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) অনুমোদন দিয়ে গেছে। এমনকি নজিরবিহীন উদ্ভাবনীর ফাঁদ তৈরি করে আইপিওতেই বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। চাঙা সেকেন্ডারি বাজারে প্রাথমিক বাজারের এই অতিমূল্যায়নের প্রভাবে নতুন বুদ্বুদ তৈরি হয়েছে। এসইসি ক্ষেত্রবিশেষে নীতি-সহায়তা তৈরি করেও তাকে উৎসাহ জুগিয়েছে।
এর ফলে শেয়ারবাজারে যে বড় বিপর্যয় আসবে, এ আশঙ্কা দেশি-বিদেশি সংস্থা ও বিশেষজ্ঞ অনেকেই সরকার ও এসইসিকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু বাজারে নতুন কারসাজির সিদ্ধান্তই আসতে দেখা গেছে বারবার।
স্টক এক্সচেঞ্জে কোম্পানির সরাসরি তালিকাভুক্তির (ডাইরেক্ট লিস্টিং) ক্ষেত্রে এসইসি নজিরবিহীন ছাড়ের দৃষ্টান্ত তৈরি করে। সরাসরি তালিকাভুক্তিতেও প্লেসমেন্ট শেয়ারের সুযোগ দেওয়া এবং এই শেয়ারগুলোর হাত বদলে কোনো বাধানিষেধ ছিল না। অর্থাৎ একটি কোম্পানি ডিএসইতে সরাসরি তালিকাভুক্ত হলে এই কোম্পানির শেয়ারের বাজারদর শুরুতে কী হবে, সেটা নির্ধারণ করার দায়িত্ব যাদের দেওয়া হয়েছে, তাদেরও কোম্পানি আগাম শেয়ার বরাদ্দ দিয়ে রেখেছে। এ ছাড়া কোম্পানির শেয়ারের প্লেসমেন্ট বিক্রি করতে ডিএসইর ব্রোকার ও মার্চেন্ট ব্যাংককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এই ব্রোকার বা মার্চেন্ট ব্যাংক বিভিন্ন বিনিয়োগকারীর কাছে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি প্রিমিয়াম নিয়ে তা বিক্রি করেছে। এদেরই কোনো কোনো বিনিয়োগকারী আরেক বিনিয়োগকারীর কাছে আরও উচ্চ মূল্যে শেয়ার বেচার একধরনের অলিখিত চুক্তি করে টাকা নিয়ে গেছে। এসবের মাধ্যমে কোনো বিনিয়োগ ছাড়াই ফরোয়ার্ড সেলের মাধ্যমে বড় অঙ্কের মুনাফা তুলে নিয়েছে অনেকেই। প্রাথমিক শেয়ারের দর নির্ধারণে হিসাবে কারসাজি (অ্যাকাউন্টিং জাগলিং) যেমন ছিল, তার চেয়ে ভয়াবহ ছিল এই প্রাথমিক বাজারের প্লেসমেন্ট শেয়ারের অবৈধ ‘কার্ব’ ব্যবসা। এ কাজে ডিএসইর নেতৃত্বের অনেকেই যুক্ত ছিলেন। এমনকি সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে এসইসির কোনো কোনো কর্মকর্তা এতে জড়িত থাকার তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এতে বাজার নিয়ন্ত্রণের কাজটিই কেবল বাধাগ্রস্ত হয়নি, বরং নতুন বুদ্বুদ তৈরি করতে ক্ষেত্রবিশেষে সরকার, এসইসি ও সংসদীয় স্থায়ী কমিটি থেকে ম্যানিপুলেটিভ (মূল্য কারসাজি) সিদ্ধান্ত এসেছে বারবার।
একটি কোম্পানির উদাহরণ দেওয়া যাক। বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে এই কোম্পানির শেয়ারের নির্দেশক মূল্য ছিল ১৬২ টাকা। এটা ধরে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম প্রথম দিনে ৩৪১ টাকা উঠেছিল। আর বাজারে ধসের আগে গত ৯ ডিসেম্বর কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ছিল ১১৮ টাকা ৫০ পয়সা। এর মধ্যেই কোম্পানিটি ২০ শতাংশ হারে বোনাস শেয়ারও দিয়েছে।
বাইরে থেকে ভুয়া বিনিয়োগকারীদেরও ডেকে আনা হয়েছে। যেমন, কেম্যান আইল্যান্ডের বিনিয়োগ কোম্পানি জেম গ্লোবালকে (যার পরিশোধিত মূলধন মাত্র এক সেন্ট) শেয়ারে ঋণ দেওয়ার অভিনব চুক্তি হয়েছে একাধিক কোম্পানির সঙ্গে। অল্প কিছু অর্থ এনে জেম গ্লোবাল চাঙা বাজারে ঋণের শেয়ার নিয়ে তা বিক্রি করেছে। আবার বিক্রির টাকায় নতুন শেয়ার নিয়েছে জেম গ্লোবাল। পরে শেয়ার বিক্রির অর্থ নিয়ে গেছে বিদেশে। এ ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রাবিনিময় আইন ভঙ্গ করা হয়েছে।
গত দুই বছরে বহুসংখ্যক কোম্পানি সম্পদের পুনর্মূল্যায়ন করেছে। শেয়ারের মূল্য বাড়াতে কোম্পানিগুলো তাদের জায়গাজমি, দালান, যন্ত্রপাতির পুনর্মূল্যায়ন করিয়েছে। এগুলোও বাজারকে স্ফীত করতে ভূমিকা রেখেছে।
আবার শেয়ারবাজারকে উপজেলা পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ব্রোকারেজ হাউস খুলে। রোড শো করে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীকে বাজারে ঢোকাতে ডিএসই-সিএসইর দিক থেকে প্রাণান্তকর চেষ্টা ও প্রলোভন তৈরি করা হয়েছে। এভাবে শেয়ারের ব্যবসায় প্রলুব্ধ করা হয়েছে দেশের তুলনামূলক অন্ধকারে থাকা লাখ লাখ বিনিয়োগকারীকে। মানুষ জমি বিক্রি করে, ধার করে অর্থ নিয়ে বাজারে ঢুকেছেন। ঢালাওভাবে ব্রোকারেজ হাউস খোলার কাজটি যখন চলেছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থা কোন কারণে সেদিকে নজর দেয়নি, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সরকার গত বছর জুলাই মাসে সঞ্চয়পত্রের সুদ কমিয়েছে আর বাজেটে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর উৎসে কর বসিয়েছে ১০ শতাংশ হারে। ওয়েজ আর্নার্স বন্ডেও সুদ কমানো হয়েছে, আবার স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনর্বিনিয়োগ বন্ধ করা হয়েছে। স্বল্প আয়ের ও পেনশনভোগীদের একবারেই নির্ধারিত কিছু অর্থপ্রাপ্তিতে করারোপ হলো, অথচ শেয়ারবাজারে মূলধনি মুনাফার ওপর কোনো কর বসানো হয়নি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর বসানোর প্রস্তাব করলেও ডিএসইর প্রভাবে শেষ পর্যন্ত শুধু প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের মূলধনি মুনাফার ওপর ১০ শতাংশ করারোপ করা হয়। ডিএসইর তৎকালীন সভাপতি রকিবুর রহমান বিভিন্ন সময় গর্ব করতেন করারোপ করতে না দেওয়ায় তাঁর ভূমিকা নিয়ে। একইভাবে তিনি ২০০৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে এসইসির দুই কর্মকর্তাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেন, তফসিলি ব্যাংকগুলোকে পোর্টফোলিও-সংক্রান্ত মাসিক রিপোর্ট পাঠানোর যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, তা কার্যকর করা হবে না। কোনো তথ্য প্রয়োজন হলে এসইসির মাধ্যমে তা সংগ্রহ করা হবে। তিনি আরও বলেছিলেন, বিনিয়োগসীমা লঙ্ঘনের দায়ে কয়েকটি ব্যাংকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে মর্মে একটি সংবাদপত্রে যে খবর প্রকাশিত হয়েছে, তা-ও সঠিক নয়।
ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সেকেন্ডারি বাজারে প্রলুব্ধ করতে ভুলভাবেও সূচক গণনা করা হয়েছে ডিএসইতে। এতে বাজারের প্রকৃত পরিস্থিতির চেয়ে অনেক উচ্চ অবস্থার তথ্য দেওয়া হয় বিনিয়োগকারীদের কাছে। তাতে তেজি অবস্থায় ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা দ্রুত মুনাফা লাভের আশায় বাজারে ঢুকে পড়েন। ডিএসইতে যখন সাধারণ মূল্যসূচক চার হাজার ৫৩৫ পয়েন্ট ছিল, তখন আন্তর্জাতিক পদ্ধতি অনুসরণ করলে সূচক হতো তিন হাজার পয়েন্টের মতো।
গ্রামীণফোনের শেয়ার লেনদেন শুরুর দিন বাজারের প্রবৃদ্ধিকে বড় করে দেখানোর জন্য আন্তর্জাতিক সূত্র না মানা ছাড়াও প্রারম্ভিক মূল্য ৭০ (অভিহিত মূল্য-১০ টাকা ও প্রিমিয়ার-৬০ টাকা) টাকার পরিবর্তে ১০ টাকা ধরে সূচক হিসাব করা হয়। এতে বাজারে সূচক কয়েক শ পয়েন্ট বেশি বেড়ে যায়। এর বাইরেও সূচক গণনায় অনেক স্বেচ্ছাচারিতা করেছে ডিএসই। যেমন, সরাসরি তালিকাভুক্ত যমুনা অয়েল কোম্পানির শেয়ার লেনদেন শুরু হয় ২০০৮ সালের ৯ জানুয়ারি। কিন্তু এর তিন দিন পর ১৩ জানুয়ারি কোম্পানিটির লেনদেনের তথ্য সূচকে যুক্ত হয়। একই ঘটনা ঘটে সরাসরি তালিকাভুক্ত এসিআই ফর্মুলেশন ও শাইনপুকুর সিরামিকসের ক্ষেত্রে। এ দুই কোম্পানি সূচকে যুক্ত হয় চতুর্থ লেনদেন দিবসে। অথচ মেঘনা পেট্রোলিয়াম ও নাভানা সিএনজি লেনদেনের প্রথম দিনেই সূচকে যুক্ত হয়। আবার ডিএসই একপর্যায়ে এসইসির অনুমোদন ছাড়াই নতুন তালিকাভুক্তসহ মোট ২৪ কোম্পানির কেবল লেনদেনযোগ্য (ফ্রি ফ্লোট) শেয়ার নিয়ে সূচক গণনা শুরু করে। এ পর্যায়ে উদ্যোক্তাদের বা ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে প্লেসমেন্টের মাধ্যমে বরাদ্দ দেওয়া যেসব শেয়ার সাময়িকভাবে বিক্রি নিষিদ্ধ (লক ইন) থাকে, তা সূচক গণনায় নেওয়া হয়নি। পরিষ্কার ইঙ্গিত মেলে যে, ডিএসই কখনো সূচককে বেশি দেখিয়ে সেকেন্ডারি বাজারে বিনিয়োগকারীকে প্রলুব্ধ করেছে, আবার যখন সূচক অতিমূল্যায়িত হয়ে পড়েছে, তখন তা নীতিনির্ধারকদের কাছে আড়াল করতে সূচক কম দেখানোর কৌশল নিয়েছে।