নতুন বছরের শুরুতেই দরপতন আর মূল্যবৃদ্ধির সর্বোচ্চ রেকর্ড দেখেছেন দেশের শেয়ারবাজারের লাখ লাখ বিনিয়োগকারী। তালিকাভুক্ত কোম্পানির অনেকগুলো কখনো দাম কমার নিম্নতম স্তর ছুঁয়েছে। পরের দিনই দাম বাড়ার সর্বোচ্চ মূল্যস্তর ছুঁয়েছে অনেক কোম্পানি। (মূলত সার্কিট ব্রেকার বা মূল্যহার সীমার মাধ্যমে প্রতি শেয়ারের দাম বাড়া-কমার সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন স্তর নির্ধারণ করে দেওয়া হয়)।
এতে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত অনেক কোম্পানির ক্রেতা-বিক্রেতা শূন্য হয়ে পড়ার দৃশ্যও দেখেছেন বিনিয়োগকারীরা। বিনিয়োগকারীদের আত্মবিশ্বাসকে ঘিরেই বাজারে এমনটি ঘটেছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান। গত সোমবার দেশের শেয়ারবাজারে ভয়াবহ দরপতন ঘটে। মাত্র ৫০ মিনিটে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে ৬৩৫ পয়েন্ট সূচক কমে যায়। ওই দিন লেনদেন হওয়া ২২৩ কোম্পানির মধ্যে ৫০টিরও বেশি কোম্পানির শেয়ারের ক্রেতা ছিল না। আর মঙ্গলবার ঘটে ঠিক উল্টো ঘটনা। ২৪৮ কোম্পানির মধ্যে ১৯৫টি কোম্পানি বিক্রেতাশূন্য হয়ে পড়ে। সোমবার ডিএসইতে দাম কমার সর্বনিম্ন স্তর স্পর্শ করেছিল সায়হাম টেক্সটাইল। কোম্পানিটির বাজারদর প্রায় ২০ শতাংশ কমে যায়। কোম্পানিটির ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ারের দাম ১২৮ থেকে কমে ১০১ টাকায় নেমে আসে। এতে কোম্পানির শেয়ার ক্রেতাশূন্য হয়ে যায়। কেননা, ক্রেতারা এই ভেবে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল যে, এভাবে পরের দিনগুলোয় দাম আরও কমবে। পরের দিন মঙ্গলবার সায়হাম টেক্সটাইলের শেয়ার লেনদেনে উল্টো ঘটনা ঘটে। ওই দিন লেনদেন শুরুর কয়েক মিনিটের মধ্যে বিক্রেতাশূন্য হয়ে পড়ে। অল্প কিছু শেয়ার লেনদেনের পরই ওই শেয়ারের আর কোনো বিক্রেতা ছিল না। ততক্ষণে অবশ্য কোম্পানির প্রতিটি শেয়ারের দাম ওই দিনের সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ মূল্যস্তর স্পর্শ করে। কিন্তু বিক্রেতাদের মধ্যে প্রত্যাশা জন্মে যায় যে, পরের দিনগুলোয় আরও বাড়বে। তাই ওই দিনের সর্বোচ্চ সীমার দরেও কেউ বিক্রি করতে রাজি হননি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ও ডিএসইর সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) অধ্যাপক সালাহউদ্দিন আহমেদ খান বলেন, ‘আমাদের বাজার এখনো অতিমাত্রায় ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীনির্ভর। এ কারণে বাজারে অস্বাভাবিক দরপতন ও মূল্যবৃদ্ধির ঘটনা ঘটে। বাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণ যত বেশি শক্তিশালী হবে, এই প্রবণতা ততই কমে আসবে।’
ক্রেতা-বিক্রেতার দরকষাকষি: নিত্যপণ্যের বাজারের মতো শেয়ারবাজারেও প্রতিদিন ক্রেতা-বিক্রেতার দরকষাকষির ঘটনা ঘটে। তবে এটি হয় প্রযুক্তির সহায়তায়, যেখানে ক্রেতা-বিক্রেতা একে অপরকে চেনেন না। ডিএসইতে ক্রেতা-বিক্রেতার দরকষাকষিতে ব্যবহার করা হয় ‘টেসা’ নামের একটি সফটওয়্যার। কম্পিউটারের পর্দায় যখন এই সফটওয়্যারভিত্তিক লেনদেন চলতে থাকে, তখন এর বাম পাশে থাকে ক্রেতা, আর ডান পাশে বিক্রেতা। ক্রেতা-বিক্রেতার ডান-বাম এই অবস্থানকে ঘিরে শেয়ারবাজারে প্রচলিত আছে ‘ডানে মারেন, বামে মারেন’ প্রবাদ। যাঁরা শেয়ারবাজারে নিত্যদিনের লেনদেনের সঙ্গে জড়িত, তাঁরাই শুধু এর অর্থ বোঝেন। বামে মারেন মানে, কোনো দরাদরি ছাড়াই বিক্রি করে দেওয়া। আর ডানে মারেন মানে, বিক্রেতা দরকষাকষি করতে চান।
স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতির এই দরকষাকষিতে কখনো বিক্রেতা আবার কখনো ক্রেতা লাভবান হন। সাধারণ বাজারের মতো এখানেও ক্রেতা-বিক্রেতার বনিবনা হলেই কেনাবেচা হয়। পণ্যবাজারের মতোই শেয়ারবাজারের সরবরাহ তথা বিক্রেতা বেড়ে গেলে দাম কমতে থাকে। একইভাবে ক্রেতা বাড়লে দাম বাড়তে থাকে। স্বাভাবিক এই প্রক্রিয়ার বাইরে কখনো কখনো কৃত্রিমভাবেও দাম বাড়ানোর ঘটনা ঘটে শেয়ারবাজারে। তবে শেয়ারবাজারের দাম নিয়ে দেনদরবারের স্বাভাবিক ধারার সঙ্গে বিনিয়োগকারীর ‘আত্মবিশ্বাসের’ রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি দেখা দিলে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে আর আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে থাকলে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়ে বাজারে। গত সোম ও মঙ্গলবার পরপর দুই দিনে দেশের শেয়ারবাজারে এরই প্রতিফলন ঘটেছে। বিনিয়োগকারীদের আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলায় সোমবার বাজারে রেকর্ড পরিমাণ দরপতন হয়েছিল। ওই দিন মাত্র ৫০ মিনিটের লেনদেনে ডিএসইতে সূচক ৬৩৫ পয়েন্ট কমে যায়। পতনের এই ভয়াবহতা ঠেকাতে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) প্রথমবারের মতো লেনদেন বন্ধ করে দেয়। আর মঙ্গলবার হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরে পান বিনিয়োগকারীরা। ফলে এই দুই দিনে বাজারে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শেয়ার ক্রেতা-বিক্রেতা শূন্য হয়ে পড়ে। বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, যখন বিনিয়োগকারীদের বেশির ভাগ অংশ ভীত হয়ে শেয়ার বিক্রি করতে শুরু করেন, তখন ক্রেতা কমতে থাকে। ভীতির মাত্রা বেড়ে গেলে একপর্যায়ে ট্রেড সার্ভারের বাঁয়ে থাকা ক্রেতা আর খুঁজে পাওয়া যায় না। একই ঘটনা ঘটে আত্মবিশ্বাসের মাত্রা অনেক বেড়ে গেলে। তখন সার্ভারের ডানে থাকা বিক্রেতাদের মধ্যে শেয়ার ধরে রাখা বা মজুদের প্রবণতা বেড়ে যায়। এখানেও বড় বড় বিনিয়োগকারী অনেকটা সাধারণ বাজারের মজুদদারের মতো আচরণ করেন। মঙ্গলবার লেনদেনের শুরুতেই বেশির ভাগ শেয়ার দাম বাড়ার সর্বোচ্চ সীমা স্পর্শ করার পর বেশির ভাগ বিনিয়োগকারীর মধ্যে আরও দাম বাড়বে—এমন প্রবণতা তৈরি হয়। ডিএসইর সভাপতি শাকিল রিজভীর মতে, ‘বাজারের কয়েক দিনের ভয়াবহ দরপতনের পর মঙ্গলবার বেশির ভাগ শেয়ারের বিক্রেতাশূন্য হয়ে পড়ার ঘটনাটি খুবই স্বাভাবিক। কারণ, এর আগেই নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। যাতে বিনিয়োগকারীরা আস্থা ফিরে পেয়েছেন।’ শেয়ারের দাম বাড়া-কমার ব্যবধান নিয়ন্ত্রণে তালিকাভুক্ত প্রতিটি শেয়ারের ওপরই সার্কিট ব্রেকার বা মূল্যস্তর নির্ধারণ করে দেওয়া থাকে। কোম্পানিভেদে এই সীমা ভিন্ন। দাম বাড়া-কমার মূল্যস্তর: ডিএসইর হিসাব অনুযায়ী, যেসব শেয়ারের বাজারমূল্য ১০০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যে, সেসব শেয়ারের সার্কিট ব্রেকার (মূল্যস্তর) থাকে ২০ শতাংশ বা ৩৫ টাকা। অর্থাৎ উল্লিখিত দামের মধ্যে থাকা কোনো কোম্পানির শেয়ার এক দিনে ২০ শতাংশ বা ৩৫ টাকার বেশি কমতে বা বাড়তে পারবে না। এভাবে যেসব কোম্পানির শেয়ারের দাম ২০১ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে, সেসব শেয়ারের মূল্যস্তর নির্ধারিত সাড়ে ৭৫ টাকা বা ১৭ শতাংশ; ৫০১ থেকে এক হাজার টাকার মধ্যকার কোম্পানির শেয়ারের মূল্যস্তর ১২৫ টাকা বা ১৫ শতাংশ; এক হাজার থেকে দুই হাজার টাকার মধ্যকার কোম্পানির শেয়ারের মূল্যস্তর ২০০ টাকা বা সাড়ে ১২ শতাংশ; দুই হাজার এক টাকা থেকে পাঁচ হাজার টাকার মধ্যকার কোম্পানির শেয়ারের মূল্যস্তর ৩৭৫ টাকা বা ১০ শতাংশ এবং পাঁচ হাজার টাকার ওপরে বাজারদর এমন কোম্পানির শেয়ারের মূল্যস্তর ৬০০ টাকা বা সাড়ে ৭ শতাংশ। বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, যখন বাজারে ধারাবাহিকভাবে দরপতন ঘটতে থাকে, তখন বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ভীতিও বাড়তে থাকে। তখন বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শেয়ার বিক্রির প্রবণতা বেড়ে যায়। কার আগে কে শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে বের হবেন, সেই প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। বাজারের এই বিপরীত চিত্র সম্পর্কে জানতে চাইলে ডিএসইর সভাপতি শাকিল রিজভী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিনিয়োগকারীরা যখন চরম ভীত হয়ে পড়েন, তখন বাজারে বিক্রেতা বেড়ে যায়। তখন বেশির ভাগ বিনিয়োগকারী নিজের হাতে থাকা শেয়ার অন্যদের আগে বিক্রি করতে চান। এ সময় শেয়ার ধরে রাখার ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন তাঁরা। আবার দাম যখন বাড়তে থাকে, তখন বিনিয়োগকারীদের আত্মবিশ্বাসও অনেক বেড়ে যায়। এতে বেশির ভাগ বিনিয়োগকারীর মধ্যে শেয়ার ধরে রাখার প্রবণতা তৈরি হয়। এই দুই প্রবণতার অসামঞ্জস্যতায় বাজার অস্বাভাবিক আচরণ করে।’ কেনা-বেচার বিশেষ পন্থা: শেয়ারবাজারে যারা বড় বিনিয়োগকারী, তাঁরা সাধারণ বা ছোট বিনিয়োগকারীদের চোখ ফাঁকি দিতে সময়ে সময়ে বিশেষ পন্থা অবলম্বন করেন। তেমনি দুটি পন্থা হলো ফিল অ্যান্ড কিল এবং ড্রিপ। শেয়ার কেনা-বেচা উভয় ক্ষেত্রেই এই দুটি পন্থা ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বড় অঙ্কের শেয়ার কেনা-বেচার ক্ষেত্রেই এই পন্থা অবলম্বন করা হয়। ট্রেড সার্ভারের সামনে বসে থাকা সাধারণ বিনিয়োগকারীরা যাতে বড় বিনিয়োগকারীদের কেনা-বেচার খেলা সহজে বুঝতে না পারেন, সে জন্য এই দুটি পন্থার ব্যবহার হয়ে থাকে। ফিল অ্যান্ড কিলে একসঙ্গে অনেক শেয়ার কেনা-বেচার সুযোগ থাকে। আর ড্রিপ পন্থায় ধাপে ধাপে শেয়ার কেনা-বেচা হয়। সফটওয়্যারেই এসব পন্থা স্থাপন করে দেওয়া আছে। তবে বড় ধরনের কেনা-বেচার ক্ষেত্রেই এসব পন্থা ব্যবহারের সুযোগ মেলে। এতে করে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বুঝতে পারেন না আরেকজন বড় বিনিয়োগকারী এক আদেশে কী পরিমাণ শেয়ার কিনলেন বা বিক্রি করলেন। একসঙ্গে অধিক পরিমাণ শেয়ারের ক্রয় বা বিক্রয় আদেশ দেখে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ওই শেয়ার নিয়ে কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়েন। বেশি শেয়ারের ক্রয় আদেশ দেখলে বিক্রেতা সাবধান হয়ে যান। তাঁরা তখন দরকষাকষি করতে থাকেন দাম বাড়ানোর জন্য। আর বড় বিক্রয় আদেশ দেখলে ক্রেতারা দাম কমানোর জন্য দরকষাকষি করেন। এভাবে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা যাতে শেয়ার কেনা-বেচায় খুব বেশি দরকষাকষির সুযোগ না নিতে পারেন, সে জন্য ‘ফিল অ্যান্ড কিল’ ও ‘ড্রিপ’ পন্থা অবলম্বন করেন বড় বিনিয়োগকারীরা। ধরা যাক, একজন বিক্রেতা একটি নির্দিষ্ট দামে (এক হাজার টাকা) কোনো কোম্পানির এক লাখ শেয়ার বিক্রি করতে চান। তখন তিনি ড্রিপ অনুসরণ করবেন। এটা করতে গিয়ে তিনি এক লাখ শেয়ারেরই বিক্রয় আদেশ দেবেন, কিন্তু ড্রিপ দেবেন এক হাজার শেয়ার। অর্থাৎ ক্রেতারা পর্দায় দেখতে পাবেন যে এক হাজার টাকা দরে এক হাজার শেয়ার বিক্রি হবে। এভাবে যতক্ষণ না এক লাখ শেয়ার বিক্রি শেষ হচ্ছে, ততক্ষণ পর্দায় ওই দর ও পরিমাণ ভাসতে থাকবে। তারপর তা অদৃশ্য হয়ে যাবে। ক্রেতারা বুঝতেই পারবেন না যে আসলে এক লাখ শেয়ার বিক্রির আদেশ দেওয়া ছিল। একইভাবে বড় ক্রেতা ড্রিপ দিয়ে বিপুল পরিমাণ শেয়ার কিনতে পারেন। আবার একজন ক্রেতা এক লাখ শেয়ার কিনতে চান। তখন বাজারে ওই শেয়ারের বিভিন্ন দামে বিভিন্ন পরিমাণ বিক্রির আদেশ রয়েছে। যেমন: ৯০০ টাকায় এক হাজার শেয়ার, ৯২৫ টাকায় দেড় হাজার শেয়ার ইত্যাদি। দেখা গেল, এভাবে ৯০০ থেকে এক হাজার ১০০ টাকায় মোট এক লাখ শেয়ার বিক্রির আদেশ রয়েছে। ফিল অ্যান্ড কিল অনুসরণ করে ক্রেতা এক হাজার ১০০ টাকা দরে ক্রয় আদেশ দিয়ে দেবেন। এতে করে ওই কোম্পানির সব শেয়ার (যেগুলো বিক্রয় আদেশ দেওয়া আছে) ক্রেতার কাছে চলে যাবে। যদি এক লাখ শেয়ারের কম পরিমাণ (যেমন ৭০ হাজার) বিক্রয় আদেশ থাকে, তাহলে ওই ৭০ হাজারই ক্রেতা পাবেন। বাকি ৩০ হাজার ক্রয় আদেশ বাতিল হবে; যাকে বলা হচ্ছে কিল। আর যা পেলেন, তা হলো তার ফিল।
source