মার্জিন ঋণ নীতিমালা তৈরির পর এক বছর পার হলেও এর কার্যকারিতা নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। গ্রাহকদের দেয়া নতুন ঋণের ক্ষেত্রে নীতিমালা কার্যকর হলেও পুরনো ঋণের ক্ষেত্রে তা সমন্বয় করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে শেয়ারের দর কমে গিয়ে ঋণসীমা অতিক্রম করলেও আইনগত ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না। বাজারের নেতিবাচক পরিস্থিতিতে মার্জিন ঋণ নেয়া পোর্টফোলিও ঋণাত্মক হয়ে পড়ায় সমন্বয় কঠিন হয়ে পড়ছে বলে ঋণপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো জানিয়েছে। এতে নতুন করে বিনিয়োগ ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
মার্জিন ঋণ নীতিমালার বিষয়ে বিএসইসির মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এটি নতুন ও পুরনো— দুই ধরনের ঋণের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে। ২০১৪ সালের জুলাইয়ের মধ্যে মার্জিন ঋণ ধাপে ধাপে বিএসইসির নির্ধারিত সীমায় নামিয়ে আনতে হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যদি কেউ নির্দেশনা মানতে না পারেন, তাহলে সেটি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতা। আমরা দেখব নীতিমালা পরিপালন হয়েছে কিনা।’
গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর দাতা সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) শর্তানুযায়ী মার্জিন ঋণ নীতিমালার অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। মার্জিন ঋণের তত্কালীন হার (১:২) বহাল রেখে ধাপে ধাপে পরবর্তী তিন বছরের মধ্যে এডিবির শর্তানুযায়ী মার্জিন ঋণের হার ১ অনুপাত দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন। নীতিমালা অনুযায়ী ২০১৩ সালের ১ জুলাই থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মার্জিন ঋণের হার ১ অনুপাত ১ দশমিক ৫ শতাংশ কার্যকরের নির্দেশনা রয়েছে। তবে নতুন ঋণের ক্ষেত্রে এ হার কার্যকর হলেও পুরনো ঋণের ক্ষেত্রে তা সমন্বয় হচ্ছে না।
জানা গেছে, বর্তমানে শেয়ারবাজারে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকার মার্জিন ঋণ রয়েছে। এ ঋণের উল্লেখযোগ্য অংশই বিতরণ করা হয়েছে ১ অনুপাত ২ হারে (গ্রাহকের তহবিলের দুই গুণ মার্জিন ঋণ)। আগামী বছরের জুলাই থেকে ঋণ প্রদানের হার হবে ১ অনুপাত দশমিক ৫। এক্ষেত্রে ধীরে ধীরে পুরনো ঋণ সমন্বয় করতে না পারলে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ ঝুঁকি তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। একই সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ সক্ষমতাও কমে আসবে।
এ প্রসঙ্গে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক সিকিউরিটিজ লিমিটেডের পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, ‘বাজার পরিস্থিতির কারণে বিতরণ করা পুরনো ঋণ সমন্বয় কঠিন হয়ে পড়ছে। যদিও নতুন ঋণ নীতিমালা অনুযায়ী বিতরণ করা যাচ্ছে। আর পুরনো ঋণ সমন্বয়ের জন্য আমরা গ্রাহক পর্যায়ে আলোচনা চালিয়েছি। আশা করছি, বাজার ভালো হলে ঋণ সমন্বয় করা যাবে। তবে আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, ২০১৪ সালের জুলাইয়ে ঋণ অনুপাত কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী নামিয়ে আনা।’
ঋণ প্রদানকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনায় জানা গেছে, ২০১০ সালের বিপর্যয়ের পর এমনিতেই মার্জিন ঋণের একটি বড় অংশ আটকে গেছে। সময়মতো বাধ্যতামূলক বিক্রির (ফোর্সড সেল) মাধ্যমে ঋণ সমন্বয় করতে না পারায় বড় ধরনের ক্ষতির মুখে রয়েছে ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। এ অবস্থায় নীতিমালা তৈরির পর বিতরণ করা মার্জিন ঋণ ধাপে ধাপে সমন্বয় না হলে এসব প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ ঝুঁকি আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। পুরনো ঋণ হালনাগাদ না করায় এরই মধ্যে ঋণ বিতরণকারী অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই তারল্য সংকটে ভুগছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান ঋণ বিতরণও বন্ধ করে দিয়েছে। তারল্যসংকট কাটাতে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান উদ্যোগ নিলেও শেষ পর্যন্ত আইনি সীমাবদ্ধতার কারণে অর্থ সংগ্রহ করা যায়নি।
এ ব্যাপারে মার্কেন্টাইল ব্যাংক সিকিউরিটিজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মনজুম আলী বলেন, ‘পুরনো ঋণের ক্ষেত্রেও কমিশনের নিদের্শনা প্রযোজ্য। তবে বর্তমান বাজার পরিস্থিতির কারণে পুরনো ঋণ সমন্বয় করা কঠিন। বাজার পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে ধারাবাহিকভাবে সমন্বয় করতে হবে।’
মার্জিন ঋণের সংকট নিয়ে তিনি বলেন, মার্জিন পোর্টফোলিওতে বিপুল পরিমাণ অর্থ আটকে থাকায় বর্তমানে ব্রোকারেজ হাউসগুলো নতুন করে ঋণ দিতে পারছে না। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে গ্রাহকের একক ঋণসীমা (সিঙ্গেল পার্টি এক্সপোজার) থাকায় সাবসিডিয়ারি কোম্পানি হিসেবে মূল কোম্পানি থেকে ঋণ পাওয়াও যাচ্ছে না। অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হলে ওই ব্যাংককে কাউন্টার গ্যারিন্টি দিতে হয়। সেক্ষেত্রে নতুন ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুসারে ওই ঋণ সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের শেয়ারবাজারের এক্সপোজারে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। এতে ব্রোকারেজ হাউসগুলো নতুন ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে অর্থ সংকটে পড়ছে।
তারল্যসংকট থেকে ব্রোকারেজ হাউসগুলোকে উদ্ধারের জন্য মার্চেন্ট ব্যাংকের মতো স্থায়ী আমানত (এফডিআর) সংগ্রহের অনুমোদন দেয়া যেতে পারে বলে মনে করেন মনজুম আলী। এতে ব্রোকরেজ হাউসগুলোর নতুন অর্থ সংস্থান হবে, যা ঋণ আকারে গ্রাহকদের বিতরণ করা যাবে।
প্রসঙ্গত, ২০১০ সালে শেয়ারবাজার অতিমূল্যায়িত হওয়ায় বিএসইসি ১০ বার মার্জিন ঋণের হার পরিবর্তন করে। এতে বাজার প্রভাবিত হওয়ার অভিযোগে একটি নীতিমালা তৈরির দাবি ওঠে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের নির্দেশনার দেড় বছর পর ২০১২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর মার্জিন ঋণ নীতিমালার অনুমোদন দেয় বিএসইসি।
- See more at: http://bonikbarta.com/sharemarket/2013/11/10/21852#sthash.3QPhH3QK.dpuf